Wednesday 31 October 2018

।। কবিতা আশ্রম অনলাইন ।। নভেম্বর সংখ্যা ।। ২০১৮ ।। ( দ্বিতীয় সংখ্যা ) ।।


কথা

আমাদের উঠোন জুড়ে শ্যামাকার্তিক। হৃদয়ে অনন্ত আতসবাজি নিয়ে স্বপ্নগম্বুজে পাগল হওয়া আরও একবার। ভূতচতুর্দশীর নিশিআলোস্নানে আমরা ফের মেতে উঠব বুঝি-বা। ভূত-ই সত্য তবে? কবির নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাবার পর কি অতল থেকে জেগে ওঠে না তাঁর অমৃত কণ্ঠস্বর? ভবিষ্যৎ কি লুকিয়ে নেই সেইসব কণ্ঠে? কবি নিত্য মালাকারও আমাদের ছেড়ে পঞ্চভূতের দেশে বিলীন হয়ে গেলেন, তবু জেগে রইল তাঁর অমৃত কণ্ঠ, “যাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম সে আর যাইহোক আমার অর্জন নয়” (‘বিগ্রহ’/ নিত্য মালাকার’)। ‘অর্জন নয়’ বলেই বোধহয় আমাদের ‘জড়িয়ে’ ধরার মায়া থেকে চলে যেতে হয়। জন্মের বিরুদ্ধে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে তাই ক্ষোভ দানা বাঁধে। তাই বুঝি ফের কণ্ঠ বাজে, “ক্ষোভ গভীর হোক, ক্রমশ নির্মিত হোক সেই সে স্ফটিকবিন্দু যাকে তুমি/ কিছুতেই মৃত্যুময় কোনো শব্দে ধরতে চেয়ে মূঢ়তায় রক্তিম হবে না।” ( ‘বিগ্রহ’/ নিত্য মালাকার)। অনন্ত কবিতার কাছে নত হয়ে বলব, হে কবিকণ্ঠ, আমরাও যেন ধীরে-ধীরে নির্মাণ করতে শিখি সেই ‘স্ফটিকবিন্দু’, যাকে ধরতে চাওয়ার মূঢ়তায় যেন কিছুতেই ছুঁয়ে না-ফেলে কোনও মৃত্যুশব্দ।



সূচি


সাক্ষাৎকার: কবিতা আশ্রম-এর নেওয়া নিত্য মালাকারের সাক্ষাৎকার
গদ্য-১: রাখা রয়েছে মেঘ যখন যেমন চাই(প্রসঙ্গ: নিত্য মালাকার):রিমি দে 
 গদ্য-২: চিতাবাঘের ডাকে ঘুম ভেঙে যেত (প্রসঙ্গ: যামিনী রায়): সুদীপ বসু
বই উৎসব: কতবার ভেবেছি পুনর্বার জেগে উঠি: পাঠক সেনগুপ্ত
ছোটগল্প: ঘোড়া: অমিতকুমার বিশ্বাস



কবিতা আশ্রম অনলাইন ( ব্লগজিন )-এর কার্যকরী সম্পাদক: তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়  


শিল্পী:চন্দন মিশ্র 


।। কবিতা আশ্রম-এর শরৎ সংখ্যা ১৪২৩-এ প্রকাশিত নিত্য মালাকারের সাক্ষাৎকার ।।

কবি নিত্য মালাকারের ছবিটি ফেসবুকের সৌজন্যে প্রাপ্ত




।। রাখা হয়েছে মেঘ যখন যেমন চাই ( প্রসঙ্গ: কবি নিত্য মালাকার) ।। রিমি দে ।।

রাখা হয়েছে মেঘ যখন যেমন চাই           
রিমি দে



মনে হয় সত্যমিথ্যের যমজ-জন্মের আগে গান ছিল–––আমার এক প্রিয় কবির (উৎপলকুমার বসু) উচ্চারণের সূত্র ধরে বলি, ওই মনে হওয়া গুনগুন থেকেই তুলে নেওয়া যায় হাসি ও হাহাকার। এমন একটি ফুলের দিনের জন্য কবিতা লেখা, যে-দিনে ফুল ও কবিতা বৃষ্টি হয়ে ঝরতে-ঝরতে বয়ে যায় নিজের ধারায়। সে-ধারাপাতে কবির মোহ মোহন ও অর্জন এমন এক সংকেত বহন করে যেখানে কবি নিঃস্ব হয়ে যেতে চায়, আবার এক আশ্চর্য অপূর্ব যা শুধু বাঁশির নীরব সুরে অন্তরের অন্দরে কানায় কানায় ভরিয়ে দেয়।   
               একজন প্রকৃত কবির ধারা কোন খাতে বইবে তা অজানা। তবে ভিতরঘরের পাগলগুলো যখন আগল খুলে দেয়, তখন কবির রোগ ও রোগমুক্তির কারণ কবিতাকেই নির্দেশ করে। কবি নিরুদ্দেশ হন কবিতায়। এমন এক নিরুদ্দেশের কবি নিত্য মালাকার। ভারত স্বাধীন হবার দু’দিন পরেই ওঁর জন্ম। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৮-ই আগস্ট। জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে। ১৯৫৬ সাল থেকে নবদ্বীপবাসী। তারপর কোচবিহার জেলার মাথাভাঙ্গায় চাকরিসূত্রে এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। বাহান্ন বছর ধরে কবিতার সঙ্গে নিত্য মালাকারের ঘর করা। এ-কোনো সহজ কথা নয়। উনিশ-কুড়ি বছর থেকেই কবিতা তাঁর মন চুরি করে। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় কবিতায় ডুবে থাকা। নবদ্বীপে থাকাকালীনই একটু-একটু করে কবিতার কাছে চলে আসেন নিজেরই অজান্তে। পরিনত বয়সে নদী মানসাইয়ের পাশে বসবাস করতে-করতে ভিতরেও এক মানসাই লালন করতেন। তাইতো নির্জনতাই নিত্য মালাকারের পরমপ্রিয় হয়ে ওঠে।
               নিত্য মালাকারের কবিতা মানেই এক নিভৃত পথিকের নিরুচ্চার কণ্ঠ। স্বগতোক্তির মতো সত্যভাষ। যেন এক অনন্ত ব্রহ্মনাম। সময়কে সঙ্গী করে ভাবে-বৈভবে-দর্শনে চরম বিন্দু ছুঁয়ে থাকার প্রবনতা। লৌকিককে কবিতার অলৌকিকে পৌঁছে দেবার যাদুটোনায় নিত্য মালাকার সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বাংলা আকাদেমি থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। পেয়েছিলেন ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি বিভা চট্টোপাধ্যায় স্মারক সম্মান’। তবু প্রান্তে বসবাস করার জন্য সেই প্রচারের আলো তেমনভাবে ওঁর কবিতায় পড়েনি। প্রকৃত কবি কি আর প্রচার চান? কবি চান নির্ভেজাল কবিতাযাপন। কবি চান সত্যের খুব কাছে থেকে জীবনদর্শন। আর দর্শনের গভীর থেকে উঠে আসবে সেইসব আশ্চর্যময় কুয়াশাঢাকা কবিতা। যে কবিতা স্বল্প ছুঁয়ে ফেললে আরো নিবিড় করে পাবার ইচ্ছে জাগে। অথচ তার রহস্যময়তাকে কখনওই ভেদ করা যায় না। কবি নিত্যর কবিতার কী এক অমোঘ আকর্ষণ যা নিয়ত তাড়া করে নিবিড় পাঠককে! নিত্য মালাকার স্বমহিমায় মফস্বলের ঝিঁঝিডাক আর জলফড়িঙের মধ্য থেকে মুক্তোর যাপনটুকু আলগোছে কুড়িয়ে ভাষার দ্যোতনায় উপলব্ধিকে বেঁধে ফেলেন পঙক্তিতে। অনুভবের গভীরতায় রচিত হয় নিবিড় উচ্চারণ:    
        ইদানিং বৃষ্টির দিনে কিছুটা এগিয়ে হেঁটে পেয়েছি ব্রহ্মস্বাদ
                               এবং প্রতিভাময়ীর ওই অতুল উষ্ণতা
        পেয়েছি পাখির ডাক দোয়েল ও শিমুলের চৈত্র-রটনা
        উত্তরোত্তর পর্যায়ক্রমে দেখেছি বিরহ-খাদ
                                            দেখেছি সমুহ
        এবং তা সতত গোলাপি আর ঘাসের জঙলে উদগ্রীব
        হেসেছি প্রভাত ছুঁয়ে সন্ধ্যা-রাত্রি ছুঁয়ে ওই অভিমুখে
                                    নত, প্রণত হতে-হতে
        কেঁদেছি, বলেছি কথা বিন্দু-বিন্দু থেকে বারিকণা থেকে

                ‘আমাদের ঘোড়া’  কবিতায় তিনি বলেন:

আহ, কী সবুজ-বলে
আর্তনাদ করে উঠল আমাদের ঘোড়া

আহ, কী অগাধ বলে
ভেঙে কুটিপাটি হল আমাদের ঘোড়া

মনে পড়ে, কখনো এমন কথা
তোমাকে বলেছি?

বলেছি, বলেছি

                 বাস্তবের অনুষঙ্গই উঠে আসে কবি নিত্যর নিত্যদিনের কবিতার আনাচকানাচ। অথচ অসাধারণ দক্ষতায় তা আবহমানের ইঙ্গিতের বাহক। ‘মাধব’, ‘যাদব’, ‘গোঁসাই’, ‘ব্রহ্ম’-----এই শব্দগুলি ওঁর কবিতায় ঘুরেফিরে আসে। গৃহী হয়েও এক বাউলমন ওঁকে তাড়িয়ে বেড়াত খুব।  
                হৃদয়ের গহীন থেকে দেখানো এই সহজ জীবনের সহজিয়া রূপের আড়ালে দীক্ষার যে গভীর মর্মার্থ উঁকি দেয় সেখানেই নিত্য মালাকার ওঁর নিজস্ব ভাষাবোধ ও উপলব্ধিতে অনন্য, অগাধ ও চিরকালীন। প্রচুর কবিতার পঙক্তি বুকে ধরে রাখার মতো। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি! ওঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল ‘অন্ধের বাগান’, ‘সূত্রধরের স্বগতোক্তি’, ‘দানাফসলের দেশে’, ‘গীতবিতানপ্রসূতরাত্রি’, ‘এই বৃষ্টিধারা’, ‘যথার্থ বাক্যটি রচনার স্বার্থে’ ও ‘নিমব্রহ্ম সরস্বতী’। ‘মাথার ভেতরে নক্ষত্রখচিত রাত্রি’ নিয়ে নিত্য মালাকার ছটফট করেন কবিতার জন্য। বলেন:
বুঝি, ভুলিয়ে-ভালিয়ে আনা হয়েছে এখানে
যতই পাথর হোক, অমসৃণ, কঠোর বা নির্জন—
দেখছি অর্কিড-নরম আর নিচে, মহা নিচে স্বচ্ছন্দ জল
 নিজেই নিজের বুক ঢাকছে ফেনায়...

শিল্পী: চন্দন মিশ্র 

।। চিতাবাঘের ডাকে ঘুম ভেঙে যেত ( প্রসঙ্গ: যামিনী রায়) ।। সুদীপ বসু ।।

কবিতা আশ্রম-এর জুলাই সংখ্যা ২০১৮ (মুদ্রিত) থেকে:  


                              চিতাবাঘের ডাকে ঘুম ভেঙে যেত
                                    (প্রসঙ্গ:যামিনী রায়)  
                                                    সুদীপ বসু



কলকাতা: জীমূত চলে গেল...
যামিনী: ওই কথাটা তুলো না...ওর কথা ভাবলে আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে...আমার মাথার সব কোষগুলোও ঠোকাঠুকি শুরু করে দেয়------
কলকাতা: জীমূতের মৃত্যুর জন্যে তুমি কি কিছুটা নিজেই দায়ী?
যামিনী: জানি না (কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে)...একেবারেই জানি না...দারিদ্র্য ছিল...চরম দারিদ্র্য ছিল তখন...সেই ট্রাঞ্জিসন পিরিয়ডটায়...পোর্ট্রেট ছেড়ে নিজের চিত্রভাষা খুঁজে বেড়াচ্ছি...সংসারের প্রতি চরম অবহেলা করেছি তখন...সেই সময়টায়...ধর্ম, জীমূত ওদের এক জায়গায় মুড়ি কিনে দিতাম সারা দিনের খাবার জন্যে...রবীন্দ্রনাথ সেই সময় বলেছিলেন আমার স্ত্রীকে ‘যামিনী যে পথ নিয়েছে তাতে তো তোমাদের দুজনের একবস্ত্রে থাকার কথা।’ ...সত্যিই সেইরকমই দিন গেছে আমাদের তখন।
কলকাতা: কিন্তু জীমূত তো চলে গেল আরও পরে? তখন তো তুমি অনেকটা দাঁড়িয়ে গেছ তোমার নতুন চিত্ররীতি নিয়ে?
যামিনী: সেটাই আশ্চর্য! ...তখন তো আমাদের দারিদ্র্য একটু-একটু করে সরে যাচ্ছে ...যুদ্ধের জন্যে আসা সৈন্যিকেরা আমার ছবি কিনছে একটু-আধটু...”
                                         ( যামিনী কলকাতা সাক্ষাৎকার: সঞ্জয় ঘোষ )

             বাঁকুড়া জেলা। গ্রাম বেলিয়াতোড়। গ্রামদেশের প্রাচীন অন্ধকার। প্রাগৈতিহাসিক পশুর মতো হিংস্র রহস্যময় আর কালো। রাতে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে শিশুটি ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদে। তাঁর ঘুম আসে না। কষ্টে নয়, আতঙ্কে। আতঙ্কও তো একধরণের শারীরিক কষ্ট। গ্রামের শেষ সীমানায় মাটির বাড়ি। পাশেই বেলিয়াতোড়ের গভীর জঙ্গল। সন্ধের পর অন্ধকার নামলেই সেখান থেকে ভেসে আসে হাতির ডাক, শেয়ালের তীব্র চিৎকার, চিতাবাঘের গর্জন। ভয়ে হাড় হিম হয়ে যায়। বাবা সারারাত গোয়ালে হিংস্র পশুর কবল থেকে গোরু-মোষগুলিকে পাহারা দেন লাঠি হাতে। শিশুটি আধোঘুমে ভয়ে চিৎকার করে উঠলে তিনি দৌড়ে আসেন ঘরে। শিশুটিকে সান্ত্বনা দেন, ‘ভয় নেই, এই দ্যাখো আমার হাতে রামদা, কেউ কাছে এলেই কোপ বসিয়ে দেব।’ তবু তার ভয় যেন আর যায় না।
               যায়ওনি। পরে সে যখন ধীরে-ধীরে বড় হয়েছে, সংসারী হয়েছে, কাজপাগল উন্মাদ শিল্পী হয়েছে, যামিনী রায় হয়েছে, তখনও এই জঙ্গল তাঁর মধ্যে নিরন্তর ছায়া ফেলে গেছে। এই অন্ধকারের আতঙ্ক, জন্তুজানোয়ারের অবসেশান শুধু যে যামিনী রায়ের জীবন আর শিল্পকর্মেই বারবার দেখা দিয়ে গেছে তা নয়, তাহলে তো তাও একরকম স্বাভাবিক ব্যাপারই হত, জীবনের একটা চরম সংকটের সময়ে তা যেন তাঁর নিয়তি হয়ে উঠল। আর জন্ম নিল শিল্পীর জীবনের সবচেয়ে রক্তাক্ত ক্ষতস্থান, জীবনের জমারক্ত।
              অসামান্য পোর্ট্রেট আঁকতেন যামিনী রায়। পোর্ট্রেট এঁকে তখন তাঁর খুব নামডাক। পোর্ট্রেটের বিক্রি আছে দারুণ। তাছাড়া ফরমায়েসী পোর্ট্রেট এঁকে রোজগার আরো ভালো। একজন চিত্রশিল্পীর জীবনে একে প্রাচুর্যই হয়তো বলা যায়।
              কিন্তু একজন জাতশিল্পীর কাছে পোর্ট্রেট এঁকে জীবিকানির্বাহ আর সরকারি করণিকের চাকরি করে রোজগার করা তো হরেদরে একই। এমন আর্থিক স্বচ্ছলতা সাধারণ মানুষকে আত্মতুষ্টি জোগায়, কিন্তু প্রকৃত শিল্পীকে আত্মধিক্কারে আচ্ছন্ন করে। স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও সন্তুষ্টি ছিল না যামিনী রায়ের। নতুন ছবির ভাষায় যে ক্ষুধা তাঁর আজন্মকালের, তা যেন আর প্রবলশক্তিতে আক্রমণ করল তাঁকে, এই সময়ে। তাঁর বাবা সরকারি চাকরির নিশ্চয়তায় ভরা সুখের সময় হঠাৎ খারিজ করে দিয়ে পরিবার নিয়ে বেলিয়াতোড়ের গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। গিয়ে জীবনকে স্বেচ্ছায় আরো বিপন্ন করে তুলেছিলেন। যামিনী রায়ের শিরায়-শিরায় তো সেই রক্তেরই তোলপাড় ছিল। তিনিও আকস্মিকভাবে পোর্ট্রেটের কাজ ছেড়ে নতুন চিত্রভাষার নতুন ডিকশনের সন্ধানে নেমে পড়লেন, ফলে অচিরেই চরম দারিদ্র্যের ভেতর ডুবে গেল তাঁর সংসারঅর্থ নেই, অন্ন নেই, বাড়িভাড়ার সংকুলান নেই। বাড়িওয়ালার চাপে এক উত্তর কলকাতার অঞ্চলেই বাড়ি বদলাতে হল কতবার। এক পয়সার মুড়ি, একটা সময় গেছে, যখন এইটুকুই ছিল তাঁর দুই ছেলে ধর্মদাস ও  জীমূতের সারাদিনের খাদ্য।
সুদীপ বসু 

                কিন্তু বড় শিল্পীর নিয়তি বোধহয় এইটিই। বিপন্নতা থেকে পেরিয়ে এসে আরো এক নতুন ও বড় বিপন্নতার ভেতর প্রবেশ করবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। ধীরে-ধীরে তাঁর এই নতুন ছবির সমঝদার জুটতে লাগল। ছবি বিক্রি হওয়াও শুরু হল এক-আধটা। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার, যুদ্ধের সময় যেসব সৈন্যদের ক্যাম্প পড়ত কলকাতায়, তারাও যেচে এসে পয়সা খরচ করে তাঁর ছবি কিনে নিয়ে যেতে শুরু করল। যুদ্ধের লণ্ডভণ্ড অনুভূতির ভেতর তাঁর ছবি তাঁদের দু-দণ্ড স্বস্থি দিত হয়তো।

কলকাতা: জীমূতের তো শিল্পী হওয়ার ইচ্ছে ছিল------তবে কেন দোকানে বসে সময় নষ্ট করতে দিলে?
যামিনী: এখন ভাবি হয়তো ঠিক করিনি...আমার বড়ো ছেলে ধর্ম ওটা মেনে নিয়েছিল...জীমূত হয়তো মন থেকে মেনে নিতে পারেনি পুরোটা...মাঝে-মাঝে ওকে যেন কেমন বিষণ্ণ দেখতাম...তখন অবশ্য আমার ওসব লক্ষ করবার মতো সময় ছিল না বিশেষ...ছবির ভাষা নিয়ে ক্রাইসিসে ভুগছি তখন দিনরাত...ছবির বিক্রি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। জীমূত একটু বেশি সেনসিটিভ ছিল...ওকে হয়তো আমার আরও অনেক নজর দেওয়া উচিত ছিল...”                                                                                                                          (যামিনী কলকাতা সাক্ষাৎকার: সঞ্জয় ঘোষ )

                একটা দিকচিহ্নহীন ধূ-ধূ বিজনপ্রান্তর। কয়েকটি শাল-পিয়াল ও বটের ঝুরি ছড়িয়ে আছে মাঠময়। একপাল শুয়োর সেই শুকনো পাতা চূর্ণ করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। সেই অলৌকিক নির্জনতায় পাতাভাঙার যে মর্মরধ্বনি, তা যেন ছবি ফুটে বের হয়ে আসছে।
                জীমূতের আঁকা ছবি। জীমূত ছিল আর্টিস্ট। অসম্ভব শক্তিশালী আর্টিস্টতাঁর ধারণা যামিনী রায়ের ঘরানার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছিল। হয়তো সেই কারণেই যামিনী চেয়েছিল জীমূত তাঁর সহকারী হয়ে থাকুক আজীবন, তল্পিবাহক হয়ে থাকুক। তাঁর ছবির প্রতি তাঁর ছিল চরম উদাসীনতা অথবা ভাষান্তরে অনীহা। পাড়ার মোড়ে দুই ছেলের জন্য মুদির দোকান করে দিয়েছিলেন যাতে তাঁরা নিজেদেরটা নিজেরাই বুঝে নিতে পারে। বড় ছেলে ধর্মদাস এটা সহজভাবে মেনে নিয়েছিলেন। টানাটানির সংসারে এটাই তো ভবিতব্য।
                  জীমূত পারেনি। জন্ম-আর্টিস্ট জীমূত। জন্মবিপ্লবী জীমূত। বড়দার মতোই বিপ্লবী দলে নাম লেখাল সে। কিন্তু ধর্মদাসের ব্যাপারটা জানতেন যামিনী রায়। বহুবার তাঁকে মানা করেছিলেন বিপ্লবীদলের সঙ্গে মিশতে, সন্ত্রাসবাদী বইপত্তর পড়তে। কিন্তু স্বল্পভাষী, অন্তর্মুখী জীমূত বিপ্লবীসঙ্গ করত গোপনে, বাবার সম্পূর্ণ অজান্তে। তাঁকে নিষেধের অবকাশ পাননি যামিনী।

কলকাতা: জীমূতের ঘটনাটা কী করে ঘটল?
যামিনী: তার দু-দিন আগে ও বলল, কলকাতায় আর ভাল্লাগছে না...আমি দু-দিন বেলিয়াতোড়ে ঘুরে আসি...না বললাম না...সঙ্গে ওর দুজন বন্ধুও গেল...
কলকাতা: হয়তো সেই সময় ওর চোখের দিকে তাকানোর তোমার সময় হয়নি রেখা ও রঙের সম্পর্ক নিয়ে তুমি তো খুব ব্যস্ত ছিলে তখন।
যামিনী:র চোখের দিকে কোনোদিনই আমি তেমন তাকাইনি বোধহয়...ও চলে যাবার ৫-দিন পরেই দুঃসংবাদটা পেলাম...ট্রাঙ্ককলে...আমার একজন খুড়তুতোভাই ফোন করল বেলিয়াতোড় থেকে                                                                                                                         ( যামিনী কলকাতা সাক্ষাৎকার: সঞ্জয় ঘোষ )

           আত্মহত্যা নয়জীমূত এর আগে একবার ( মতান্তরে দু-বার) আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। সে অন্য কথা। এবারকার ঘটনাটা সম্পূর্ণ অন্যরকম এবং অদ্ভুত। বাবার অনুমতি নিয়েই জীমূত বেলিয়াতোড় গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। মানসিক অবসাদ আর শহরের নিরবচ্ছিন্ন একঘেয়ে জীবনযাপন তাঁকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে এইটুকু জানা যায় যে, জীমূত যখন তাঁর দুই বন্ধুর সঙ্গে গভীর জঙ্গলে ঢোকে, সূর্য তখন প্রায় মধ্য-আকাশে। বিকেলের মুখে দুই বন্ধু জঙ্গল থেকে ফিরে এল। কিন্তু জীমূত এল না। বিকেল ফুরিয়ে এল। জঙ্গল আচ্ছন্ন হয়ে গেল প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে।
              পরেরদিন আলোয় গ্রামের মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজতে বেরোল জীমূতকে। অবশেষে জঙ্গলের ভেতর একটা ডোবার ধারে পাওয়া গেল জীমূতের স্তব্ধ মরশরীর। মুখ ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। হাতে-পায়ে এমনকী গোটা গায়ে আঁচড়ানো-কামড়ানোর নৃশংস চিহ্ন।
              কে বা কারা মারল জীমূতকে? বন্যপশু না বুনো মানুষ? সন্তাসবাদী দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলই জঙ্গলের পথে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিত খুন নয়তো? তারপর বন্যজন্তুর নাগালে মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যাওয়া? নাকি নিছকই দুর্ঘটনা, ক্ষুধার্ত জানোয়ারের তাণ্ডব? ঐ দুই বন্ধুই-বা তাঁর খোঁজখবর না-করে ফিরে এল কেন? কেনবই-বা তারা অনুসন্ধানের কাজে বিশেষ একটা হাত লাগালেন না? সেই রহস্য আজও অস্পষ্ট থেকে গেছে। খবর পেলেন কিন্তু বেলিয়াতোড় গেলেন না যামিনী রায়। দু-দিন পর গ্রামের শ্মশানেই জীমূতের দাহকাজ হয়ে গেল।
             শুধু তুলি থেমে গেল তাঁর। ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে বসে থাকতেন ঘন্টার-পর-ঘন্টা, দিনের-পর-দিন, রাতের-পর-রাত। আঁকার কোনো তাড়নাই ছিল না তাঁর। ধীরে-ধীরে গভীর অবসাদে ডুবে গেলেন যামিনী রায়। অবসাদে? না তীব্র মনোকষ্টে? অপরাধবোধে? না কি আতঙ্কে?
             শৈশবের সেই জঙ্গলের অবসেশন এতবছর পর মেজোছেলের মৃত্যুর কাঁধে ভর করে ফিরে এল নাকি?


শিল্পী: চন্দন মিশ্র 

।। বই উৎসব ।। কতবার ভেবেছি, পুনর্বার জেগে উঠি ।। পাঠক সেনগুপ্ত ।।

কবিতা আশ্রম-এর জুলাই সংখ্যা ২০১৮ (মুদ্রিত) থেকে: 

                           কতবার ভেবেছি, পুনর্বার জেগে উঠি

                        পাঠক সেনগুপ্ত


আমরা যারা বেড়েছি কাঁটালতা ঝোপঝাড় ছুঁয়ে কুঁড়েঘর, তাদের পিছলা আস্তিনভরা স্যাঁতসেঁতে কচুরিপানা, আর বানানো নদীর ঘোলাটে জলে ডুবে থাকতে-থাকতে খেয়াল করা হয়নি, কবে কীভাবে এই নগরীর একটি মেয়ের চোখের পরদায় নেমে এসেছিল ঘর, ব্যর্থঋতুর নানা স্বপ্নভঙ্গিমা আর পোড়াস্বপ্ন, পোড়ানদী পার হতে-হতে ‘ছায়ার ভিতরে মায়ামৃগের চোখে’ আমরাও কেউ বিষখালি, আবার কেউ-বা কীর্তনখোলা নদী হয়ে বেঁচে থাকলাম একটা আস্ত জীবন। ‘আমরা যারা অনন্তের পথে হাঁটছিলাম,’ বা অন্তত হাঁটছি বলে মনে করেছিলাম, সেই সুদূরের এক বন্ধু, শামীম রেজার কবিতা সংগ্রহ (চৈতন্য, সিলেট, বাংলাদেশ, টাকা ৩৩০) আসলে এক অনন্ত পথপরিক্রমার নদীকথা। এই গ্রন্থের পাতায়-পাতায়, শব্দে-শব্দে দুরন্ত এক মনখারাপিয়া বাঁশির কেবল নিজের সুরে কেঁদে-কেঁদে যাওয়া। ‘আসলে ধ্যানী নদী শুধু একা পৌঁছবে স্বপ্নসমূদ্রের মোহনমোহনায়...’ বলে শামীমের ‘পাথরচিত্রে নদীকথা’ শুনতে-শুনতে শুরু হল এই পরিক্রমণ। পথে যেতে-যেতে আমাদের কেবল আপন বৃক্ষসৌন্দর্য চেনা হল না, দীর্ঘপথ পার হয়ে গুহাচিত্রের নানা মানুষের সঙ্গে দেখা হল, কেবল জলমগ্ন হেমন্তের প্রলয় নিয়ে দাঁড়ানো রাত্তিরের কাছে কীভাবে কামাতুর লোভী বেড়াল চিৎকার করে, শোনা হল না আমাদের। ‘আপনি শুনলেন কীভাবে?’ শামীম? কী সহজে বললেন, এই লোভাতুর, কামজর্জর বেড়ালের পৃথিবীতে ‘বেঁচে আছি শূন্যতার বিষাক্ত খেলনায়...’ আর এই শ্রাবণমুষলবৃষ্টিদিন দেখে জীবনের সমস্ত জ্যোৎস্নাপাখি চলে যেতে-যেতে ফিরে আসবে, ভেবে দেখছি কেবল ‘ছিন্ন পালক পড়ে আছে চুপ’ আমাদের পুঁথিচিত্রকর হয়ে সেসব পড়ে-থাকা লিখে যাচ্ছেন শামীম, নিরন্তর...
             একবার দোলের মেলায় অচেনা সুরের নদী এসে ভর করলে আমরা আবার স্বপ্নের গন্ধে পাগল হয়ে উঠলামনিজেদের ভিতর ও অনুভূতির ভিতরে বসে থেকে পার করলাম কত যুগান্ত, কেবল সাধনা জানি না বলে দেখতে পাইনি তাকে... দেখতে পাইনি কেমন তাঁতিবউ শাড়ির পাট খুলছে আর সেই পাটে পাটে আমার অনন্ত বঙ্গদেশ পরিচিত মুখ নিয়ে আজও অমলিন থুরথুরে সন্ধ্যা হেঁটে যায়, আর নিজেকে হারিয়ে খুঁজি চেপে-ধরা এক নিঝুম-নিঃসঙ্গতায়‘আমরা কি রাত্রি-বিলাসী গাঙচিল?’ ভাবতে-ভাবতে স্মৃতির সুবর্ণনগরে রাত্তির নেমে আসছে। ‘রাত্তির নাইম্যা আসে মনের গভীরে আমার,’ আর শৈশবের শুকতারা কানে-কানে বলে যায়, ‘বলো তোমায়, কীভাবে স্বপন দেখাইএই রাত্তির জুড়ে হেতাল বনের আঁধার, শৃঙ্খলের শিকল-পরা শাপভ্রষ্টা দেবীকার মুখ, যুবতী মাংসের ঘ্রাণ গলে পড়ে, আর তারাদের স্নান সেরে উঠে-আসা এক রাত্তির অপেক্ষা লেখে আমাদের বসন্তদিনের খাতায়, নদী নিদ্রাহীন ঘুমায় আলোর আঁধারে


শামীম রেজা 


            শামিম লেখেন সেই ‘মর্গের দুয়ার থেইকা ফিইরা-আসা লাশ আমি গ্লোবাল এন্টিনায় নিজেরে শুকাই’ নিজেকে অতীত করে, আত্মঅভিমানের এত যে খেয়ালে মেতেছি আমরা, আমাদের কি মনে পড়ে না সেই দুঃখের স্বনির্মিত স্বরগ্রাম? বনপথ-মায়ার ভেতরে চলতে-চলতে কি হঠাৎ কোনও উদাস চোখের দিকে তাকালে মনে হয় না ‘তুমি দূরতম সঙ্গীত’? কেবল তোমার উদাসীমায়ার কাছে এসেও আমরা, নিজেদের এত্ত এত্ত বড় ভেবে-ভেবে ‘ছেনালী আশায় চোখ খুলতে বলি’ নির্জনতম নারীপ্রতিমাটিকেও বলতে কি ইচ্ছে করে না, ভাবতে কি ভালো লাগে না ‘বধূয়া আমার সান্ধ্যপাখির দলে, ধাঁধাময় পাহাড়ে থাকে, পথের বাঁশি হৃদয় মাঝে কাঁপে কোপাই নদীর বাঁকে...’? নিশ্চই মনে হয়, আর বিস্ময়ে সেই নিজের বিশ্বাস প্রকাশ না-করার শহুরে-অভিমানে আরশিনগরের দিকে যেতে-যেতে কোজাগরি রাত্তিরে খুঁজে ফিরি তাকে... সেই স্নিগ্ধনারীপ্রতিমা অথবা হারানো নদীটিকে 
               শামীমের মতো আমাদেরও ‘মেজাজটা খারাপ হয়া যায়, অমাবস্যা আইসা হাঁটু গাইড়া বয় পাশবারান্দায়,...’ তবু ব্রহ্মাণ্ডের স্কুল খুলে বসে কবি শুধু ব্যক্তিগত নরকে দগ্ধ হওয়া নীল অর্কিড নন‘কতবার ভেবেছি বৃক্ষজন্ম কিংবা পাখিজন্ম হতো যদি আমার/ তোমাদের জলে অবগাহন শেষে পুনঃ পুনঃ জন্ম দিতাম আবার’ সে-জন্ম নিশ্চই ব্রহ্মাণ্ডের স্কুলের, আর শামীম এক প্রদোষের জাদুকর, আমাদের দেখাচ্ছেন, ‘ওই দেখো জঙ্গল সমস্ত প্রাণীসহ চিৎ হয়া শুইয়া আছে আমার ডানায়, ঘুমপোকাদের ভিতর-বাহির কি এক অদ্ভুত পোড়াগন্ধ’...এই গন্ধ আমাদের অস্তিত্বের পুড়ে যাওয়ার? না-কি স্বপ্নের পুড়ে যাওয়ার? না-কি তাঁর সঙ্গে আমরাও বলতে পারব, ‘এতদিন পরে আমি জেনে গেছি সমস্ত জ্যোতির্ময় গোলক পাওয়া যাবে আমার আত্মার ভিতর আর এই জ্যোতির্ময় গোলকের ভিতরই আমার আবর্তন।’ আজ এই অদৃশ্য আততায়ী-সময়ে নিজেদের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, ‘আমাদের চোখগুলো নিয়া যারা মার্বেল খেলেছে মধ্যদুপুরে পশ্চিমপাড়ায়, তাদের কথা এবার থাক, পাগল হবার পূর্বে সে চোখ বন্ধ কইরা হাঁটতো আর মধ্যরাতে একা লাল ঘোড়া তার বুক থেইকা বাইর কইরা তার পিঠে চইড়া মিলায়ে যেত দূর টিলার উদিত রেখায়,...’ আমাদের সেই দূর টিলার খোঁজে এখনও অনেক রাত্তিরপথ হাঁটা বাকি

      

         এই আপন মমির খোঁজে নেমে, নিজের অনেকানেক পাথরের সঙ্গে প্রত্যেক সাফল্যের সঙ্গে দেখা হতে-হতেও কী যেন বাকি রয়ে গেছে। বুকের গভীরে কোনও এক পলাতক পাখি ডেকেই চলেছে ভোর থেকে জোছনারাত্তিরময়নিজেকে গোপন রেখে আপন বাসনামতে এই যে নিজেকে গড়ে নেওয়া আমাদের ‘এই ভালো, সেই ভালো’ জীবন, আমাদের কেন মনে হল না, শামীম, কেন বলতে পারলাম না, ‘যে তুমি শিকারি, সেই তুমিই যে নিহত শিকার মনের গভীর ডালে বসেছে দুরন্ত এক পাখি। আমাদের এসমস্ত জীবনের সব গাছে আমাদের চোখের সামনে ফোটা ফুলেরা ক্রমে ফল হয়ে গেছে, ‘ফলের মধ্যে ঘুমন্ত বীজেরা আলোর খোঁজে’ যে আমাদের মুখ চেয়ে বসে আছে কোন অতীত থেকে, আর ফুলরেণু উদ্ভাসিত এই যে জীবনের প্রার্থণাগৃহ, এত মুখরের কাছে এসে দেখছি, ‘আমাকে মানুষ করবে দায়িত্ব নিয়েছিল যে নগর/ তার হৃদয় ছিল না কোনো;/ সে ছিল গুপ্ত নিশ্চিন্ত-ঘাতকের ঘর।’ আমরা সে-ঘর দেখেছি, সেখানে জীবিত শবেরা ঘাতক চোখে চেয়ে আছে আর আমরা কী ভীষণ চিৎকারে একটু শ্বাস নিতে-নিতে বলতে পারছি, ‘বেঁচে গেছি এমন পৃথিবীতে চোখ খুলিনি বলে চারিদিকে নির্ঘুম রাতের আবর্তন কত সায়র সময় পার হলে আমরা আপনার সমান মানুষ হব, শামীম?


শিল্পী:চন্দন মিশ্র 



                                                           দুই

‘পরবর্তী আলোচক শুরু করবেন এখান থেকে’কোথা থেকে শুরু করব, অনিকেত? আপনার ‘শব্দ-নৈঃশব্দ্যের অনুরণন’ আমাদের আলোকিত করে বসে থাকে। আমাদের এই ক্লেদাক্ত জীবন, এই মুখোশপরা মহাশয়-অস্তিত্ব, নিত্যদিন কথামালা তৈরি করে এগিয়ে যাওয়া, নাটকীয় ভঙ্গিতে ক্রমশ বিন্দু থেকে গড়িয়ে পড়ার কাছে এসে আপনার কাছেই শুনলাম, ‘একটা বৃত্ত আঁকার চেষ্টায় বারবার ব্যর্থ তুমি’ আমাদের এটা-সেটার জীবনে নিজেকে ঘিরে রচনা করা বৃত্ত কবে বড় হতে-হতে মহাবৃত্ত হয়ে উঠছি আমরাই, সে-খোঁজ যে রাখা হল না। বলা হল না মন খুলে, এই জীবনের ‘সবকিছুই প্রকাশ্য হোক, কেননা আড়াল আমাদের বঞ্চিত করে তাহলে কোথা থেকে আলোচনা শুরু করব আমরা? ‘এই বোধের অতীত তুমি কীভাবে পৌঁছুবে/ সমস্ত কোলাহল থেমে যায় এই উপান্তে’? কীভাবে ফেরাব নিজেদের সমূহ পতনসম্ভাবনা? ‘মাথার ভিতর অদৃশ্য দৃশ্যাবলির লিবিড সময়’ ছেয়ে আসছে। ‘সরীসৃপের মতো এঁকেবেঁকে চলে’ যাচ্ছে সময়। আর সেই স্বপ্নিল অন্ধকার নিয়ে ভেসে যাওয়া সময়ের অনর্গল প্রতিবেদনের ভাষ্য-ভরা অনিকেত শামীমের কবিতা (বাংলালিপি, ঢাকা, বাংলাদেশ, টাকা ৩০০) এইভাবেই শুরু হয়ে গেছে চলার কাহিনি লিখে।




             আমাদের আজীবনের অন্ধপাতায় জ্যোৎস্নাবিকিরণ দেখতে-দেখতে যে ঘটনা-কাহিনির কাছে এসে বসেছি, তার সংলাপভরা পাতায় পাতায় ‘শুধু দীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিল, নিজেকে উন্মোচনের মৌনব্রত ছিল সান্ধ্যপ্রার্থণার মতো, প্রিয় নারীপ্রতিমার কানে কানে বলার ছিল, কেন আমার ভীষণ কষ্ট হয়। ‘অথচ হৃদয়ে আমার ব্যর্থতার কোনো গ্লানি নেই/ চিরকাল একা থাকার ভয় আমার মধ্যে নেই।’ আর, এমন একটা দিনের কথা ভাবুন, এমন সেই মুহূর্ত, ‘তখনো পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছোয়নি’, নিজেদের উন্মোচন ভেঙেচুরে খোঁজা শুরু হয়নি একটাও পথ। ধরুন, একদিন নিজেকে আপনি নিজের সামনে নানান সাজানো আয়নায় দেখতে-দেখতে হঠাৎ মনখারাপের সুরে বলে উঠলেন, ‘ও মন তুই কদ্দুর যাবি?’ সেইদিন অনিকেত যদি আপনাকে পালটা জিজ্ঞেস করে বসে, ‘কতদূর যেতে পারেন আপনি?’ তাহলে কী বলবেন, হে পাঠক? আমি তো বলব, ‘বেদনার ক্ষত বুকে নিয়ে কতদূর যাওয়া যায় বলো?’


অনিকেত শামীম 
            
            অনিকেতের ‘ছুঁয়ে দিই কিংবা স্পর্শের অতীত’ অনেক না-বলার মধ্যে জেগে উঠেছে মৌনপাথর হয়ে। তার কল্পনার আকাশে অন্ধকার ছুঁয়ে যায় অসংখ্য বাবুই। আর বুকের খুব কাছে নিবিড় হাত রেখে কবি বলে যান, ‘তোমার যত কষ্ট/ জমা দাও আমার হৃদয়ের কষ্টব্যাংকে। সুদে আসলে ফেরত দেবো সুখের কড়কড়ে চেক’ আহা, এই নীলকণ্ঠ আহ্বানের কাছে নত হতে যে কী সুখ, কী জ্যোৎস্নার মায়া! আনন্দ হয়। সহজ জীবনের আনন্দকিন্তু কবি আমাদের দুঃখদিনের বন্ধু। ‘তোমার আনন্দের(?) দিনে দূরে থাকা ভালো, কেননা অহেতুক চারপাশের পরিবেশ বিব্রতবোধ করবে’ বলে তিনি দূর থেকে এই জীবনকে দেখছেনএই জীবন, মানে ‘বেহালার তার ছিঁড়ে যাওয়া ভালোবাসা’। এই ‘জীবনের হিসেব মেলাতে গিয়ে একজন কেরামত আলি রক্তের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস টেনে আজীবন পালিয়ে যায়’ তবু, যাওয়া বললেই যাওয়া হয় না। দ্বিধাদ্বন্দ্ব, স্নায়ুযুদ্ধ বড় কঠিন তার কাছে এসে অনিকেত বারবার বলছেন, ‘অদ্ভুত আলোয় হেসে ওঠো’ বিশ্বাস করতে শেখো, একদিন হয়তো ঈশ্বরকে তাক লাগিয়ে ঘোষণা করতে হবে আমাদের মৃত্যুর পর কারও হস্তক্ষেপ থাকবে না। আর আমরা এই কবিতাজীবন সঙ্গে করে হাঁটতে-হাঁটতে পৌঁছে যাব সভ্যতার নতুন আবাসভূমিতে। সেই ভূমির বাগানে একটিই ফুল। ভালোবাসার। মানুষের। সেখানে দূরে-কাছে বলে কিছু নেই। নেই অন্ধ বালকের প্রতি ঈর্ষাও। জীবনের সবকটা দরজা খুলে সেখানে বলতে হবে না, ‘আমাকে আমি চিনতে পারিনি আজও’ ভাবুন, এরকম একটা বিশ্বাসের কাছে আমরা এসে গেছি সবাই। আর সেই অস্তিত্বের কাছেই আছেন অনিকেতবলতে পারছেন, ‘এই তো বাড়িয়েছি হাত/ সমস্ত ভয়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছেড়ে বাড়ালাম হাত’
             আমরাও হাত বাড়িয়েই রইলাম।  


শিল্পী:চন্দন মিশ্র 


।। ছোটগল্প:ঘোড়া।। অমিতকুমার বিশ্বাস ।।

কবিতা আশ্রম-এর জুলাই সংখ্যা ২০১৮ ( মুদ্রিত) থেকে:  

ছোটগল্প



                                 ঘোড়া   
                                     অমিতকুমার বিশ্বাস

মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে ষোড়শী মেঘগুলো ভূতশিরীষের উপর চুল খুলে বসে পড়েছে সহসা। বিকেল ক্রমশ বিলীনপথে। শ্রাবণ তেমন আর গর্জায় না আজ, তবে বর্ষায় রিমঝিম-রিমঝিম অবিরাম কাছে-দূরের তমালতরুদেশে শুধু বর্ষায় আর বর্ষায়, যেন মিঞামল্লারে ক্ষেপেছে খাঁ-সাহেবের আপন সন্তুর।  
            এবেলা আর কোনও পেশেন্ট নেই ঘরের আলোটা নিভে আসে। শার্সি থেকে পরদা সরানোয় বাইরের আলোপথ খুলে যায় জানলায় বৃষ্টিলিপি। এই প্রণয়মধু-মরসুমে আকাশ থেকে মাটির দেশে বেড়াতে-আসা জলকন্যারা কাচবিছানায় একে-একে অলঙ্কারসমূহ সরিয়ে নির্ভার হয় চিরায়ত প্রেম ও প্রকল্পের কাছে বাতাসের ধ্যান ভাঙে। মৃদু আঙুল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে একাকী বাতাস আলপনা দেয় আপন খেয়ালে কখনও সে জলহরিণের ছদ্মবেশে ছুটে যায় হরিণীর পিছে-পিছে কখনও-বা হৃদর-বাঁশিতে দেয় এক ফুঁ দুই ফুঁ, সঙ্গে-সঙ্গে সুর ও শীৎকার ওঠে মহাকাশে ধীরে-ধীরে একটা জলকণা আর-একটার খুব কাছে আসে, দৃঢ় আলিঙ্গনপাশ-ইচ্ছেতে যেন, যেন মহাবিচ্ছেদের বহুযুগ পর কিংবা তার কিছু আগেই! কম্পিত অধর আরও একটু কম্পিত মৌনমুখরতা যা কিছু সবই বৃষ্টিলিপি জানেঅযথা কথা নয় তাই আজ আর একটিও। আলোও নয়। কথাদূষণ-আলোদূষণে ঘষে যায় খসে যায় হৃদয়ের সকল করমচা-রং। এইসব ভেঙে যাওয়া ধ্যানের ভিতর, প্রেম আর খিদের ভিতর, স্বপ্নগর্ভের ভিতর একটু-একটু করে বাড়তে থাকে আমাদের শকুন্তলাবন্যপ্রভা। একটু-একটু করে বাড়তে-বাড়তে সে-প্রভা উন্মুক্ত হয় অরণ্যআশ্রমগৃহে। শেষেমেশ বৃষ্টি ও বাতাসের অনিবার্য বিচ্ছেদের পর অরণ্য চুপিচুপি বলে ওঠে, আয় খুকি, আয় লুসি, আয় আমাদের নগর-উপেক্ষিত চিরায়ত প্রেম-বিরহের আপন অরণ্য-উপাখ্যান।” নেপথ্যের শ্যামসুন্দরমধুমালা বৃষ্টির গায়ে আছড়ে-আছড়ে পড়ে; খামচে-খামচে ধরে কাচশরীর:
যদি বৃষ্টির রাতে
বাড়ি ফিরবার রাস্তাকে মনে হয়
কান্নায় ভিজে আছে...

দোলনচাঁপার গন্ধের ভূমিকাকে
তুচ্ছ করতে পারছে না কিছুতেই,
মৃত্যুর মতো অসহ্য লাগছে...

দরজা-জানলা ভেঙে ফেলো, বন্ধু!

ধুয়ে-মুছে যাক ক্ষত।   

“আসতে পারি?”
আচমকা ক্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ- শব্দের পেছন-পেছন প্রলম্বিত জিজ্ঞাসা-চিহ্ন! ঘোর ভাঙে দিদিমণির ঈষৎ খোলা-দরজা দিয়ে দোকানের আলো আগন্তুকের কাঁধের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঝাঁকরা চুলে জলের ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি তাঁর চশমাতেও ফট করে আলো জ্বালেন দিদিমণি আগন্তুকের মুখের দিকে না-চেয়েই যান্ত্রিক আন্তরিকতায় উত্তর ছোঁড়েন, “আসুন!  
             মাথা ভর্তি বৃষ্টি নিয়ে আগন্তুক ঝটপট ঢুকে পড়ে চেম্বারে, যেন এক ভেজা দাঁড়কাক হঠাৎ কার্নিশ পেয়ে বার-কয় দ্রুত ডানা ঝাপটায়, তারপর চুপিটিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ফের ঝাপটাবে? ঘরের আলোয় আগন্তুকের মুখটা এবারে বেশ বোঝা যায় স্পষ্ট দিদিমণি মনের হাই-মেগাপিক্সেলে পটাপট ছবি তুলে নেন মুহূর্তেই মধ্য-যৌবনের পুরুষ। মুখে এক হপ্তার গোঁফ-দাড়ি টিকালো নাকের ’পর মানানসই রিমলেস রং ও উচ্চতায় সত্তর দশকের বাঙালি শরীরে সবে মেদসঞ্চয় শুরু পোশাক ও হাভভাবে মনে হয় কোনও কর্মঅলস সরকারি দপ্তরে বেশ কয়েক বছর কেরানির পদ সামলাচ্ছেন। 
“বসুন
গদিহীন চেয়ারে খুব সাবধানে বসে রুমাল দিয়ে মাথা-মুখ-চশমা মুছতে-মুছতে নিজে থেকেই শুরু করলেন, “আসলে অনেকদিন চোখ পরীক্ষা করাইনি তো...”
“ও, আচ্ছা চশমাটা খুলুন...বেশ বেশ। নিন, এবারে এটা পরুন” নিজেই ট্রায়াল-ফ্রেমটা আগন্তুকের নাকের ’পর বসিয়ে দিলেন দিদিমণিতারপর তাতে ট্রায়াল-বক্স থেকে নানান পয়াওয়ারের লেন্স একে-একে বসিয়ে স্নেলেনের চার্টের দিকে তাকাতে বলেনডান চোখ, বাম চোখ, ক্রমে দু-চোখ দিয়ে একসঙ্গেপরে কাছের চার্টও  সামনে মেলে ধরেন
“দেখুন তো!” 
“একটু ঝাপসা
“এইবার?”
“একটু কম
 “এইবার?” 
 “হ্যাঁ হ্যাঁ, এইবার...এইবার একদম ক্লিয়ার ম্যাডাম, একদমই...” 
             দেরি না-করে প্যাডে খচাখচ পাওয়ার লিখে বলেন, নামটা কী যেন...
“নাম? ওহো, নাম কি লিখতেই হবে?”
কলমটা থামিয়ে মুখটা তুললে আগন্তুন যেন ঘাবড়ে যান। অগত্যা আগন্তুক বলেন, “...বেশ তো, লিখুন না, নাম...আজ্ঞে নাম হল শ্রীরবীন্দ্রনাথ...”
নামটা শুনেই বেদম হাসি পায় দিদিমণির প্রথমত নামের আগে ‘শ্রী’। এখন তো আর কেউ এমন বলেন না, লেখেনও না, নিজের বেলাতে তো নয়ই তার উপর আবার ‘রবীন্দ্রনাথ’! এরপর হয়তো পদবিটা ‘ঠাকুর’ না বলে বসেন! না, একদমই হাসা যাবে না পেশেন্টের সামনে। তাতে নিজের পেশাদারী ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
“পুরো নাম?”
“বাবার নাম বলতে হবে নাকি আবার?”
“তা কেন? নিজের পুরো নামটাই বলুন না, আই মিন পদবি-সহ
“ওহো, আমি ভাবলাম, ‘নাম বিজয় দীনানাথ চৌহান, পুরানাম বাপকা নাম দীনানাথ চৌহান...’, হে হে...ম্যাডাম, আমার পুরো নাম শ্রীরবীন্দ্র নাথ। ‘শ্রীরবীন্দ্র’ হল আমার নাম, আর পদবিটা ‘নাথ’ 
“ও হো! আচ্ছা আচ্ছা! বেশ ইন্টারেস্টিং! আর বয়স?”
“...উমর ছত্তিশ সাল ন’ মাহিনা আট দিন...”
“আরে থামুন থামুন! ঐ ছত্রিশেই হবে। তা আপনার ফিল্মেটিল্মে সখ আছে বুঝি?”
“সে তো আপনারও আছে
              পেশেন্টের সঙ্গে অযথা বেশি কথা না-বলাই ভালো, কী বলতে আবার কী বলে ফেলবেন!
“আচ্ছা বেশ, আসুন তবে নতুন চশমা বানিয়ে পাওয়ার চেক করিয়ে নিয়ে যেতে পারেন
“আচ্ছা ম্যাডাম, একটা কথা ছিল, বলব? বলতে কিন্তুড্ড সংকোচ-বোধ হয়। এর আগে দুজনকে বলেছিলাম, তাঁরা আসলে বিশ্বাস করেননি কেউ
            এই সেরেছে! আবার কী বলবেন ভদ্রলোক? বলতে না-দিয়েও তো উপায় নেই! কী এক উটকো ঝামেলা এই বৃষ্টিদিনে  
“আচ্ছা বলুন সংক্ষেপে আমার উঠে যাবার সময় হয়েছে কিন্তু
“এই বৃষ্টিতে?”
ঝুঁকি বুঝে কোনও উত্তর দিলেন না। বরং স্মার্টফোনে মিথ্যে-মগ্নতার মধ্য দিয়ে প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করতে লাগলেন।
“ম্যাডাম, গত বছর বর্ষার পর-পরই আমি এক ঘোর সমস্যায় পড়েছি 
“সমস্যাটা বলুন
“আপনি বিরক্ত না-হলে একটু খুলে বলি?”
বিরক্ত তো হচ্ছেনই। ঘোর বিরক্ত। তার উপর আবার কিনা খুলে! কাট-পিসটাকে সরাতে হবে দ্রুত। তাই স্ক্রিনে চোখ রেখেই নীরস কণ্ঠে বলেন, “হুম। বলুন
“আসলে প্রতিদিন বিকেলের মতোই সেদিন ডুমোবাঁওড়ের দিকে কটকটিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছি...
“ক-ট-ক-টি?”
“আমার স্কুটার
“ও, আ-চ্ছা!”
“তো, রাস্তাটা পাকা দু-পাশে বিস্তীর্ণ ধানখেত। কিছুদূর গিয়ে চুয়াখালের উপর দাঁড়িয়ে আমিহঠাৎ ঝমঝম বৃষ্টি। গত বর্ষার সেই প্রথম জানেন, ভিজতে কিন্তু ভালোই লাগছিল!
“তো?”
তো হঠাৎ খেয়াল করি, সেতুর উপর যে সিমেন্টের রেলিং ছিল, সেগুলো ওই বৃষ্টির ঝাপটায় খসে-খসে লোহার রডগুলো একদম হাঁ হয়ে যাচ্ছে   
“কী কাণ্ড!” দিদিমণির বুড়ো আঙুলের নীচে তখন হাওড়া ব্রিজমিতালি বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে ছবি পোস্টিয়েছে সবে। “আবার একটা? পারেও বটে!” মনে-মনে বলে ওঠেন। শেষে চট করে অনিচ্ছের আঙুল-স্পর্শে লাইকান। কাণ্ডই বটে!” এবারে আগন্তুকের কথায় বিরক্ত হয়ে ফের মনে-মনে বিড়বিড়ানো। এখন এই বৃষ্টিতে তাঁকে কিনা শেষে  এই গাঁজাখুরি গল্পটাও শুনতে হচ্ছে? কী আপদ রে বাবা!
“ম্যাডাম, পিকচার আভি বাকি হ্যাঁয়!”
মেরেছে রে! আবার? ফিল্মি ছারপোকাটাকে সিনেমা-হল থেকে হেঁটে সটান এখানেই হেঁটে আসতে হল?
“নিন, বাকিটাও বলুন, কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি!”  
হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম একদম।”
দিদিমণি আঙুল ঠেলে রবীন্দ্রসেতুটা সরানোর চেষ্টায়। তবু চোখ আটকে আছে মিতালিদের দিকে। ছেলেটাকে বড্ড চেনা-চেনা লাগছে তাঁর। কিন্তু...এদিকে দিদিমণিকে অন্যমনস্ক দেখে টেবিলে ঝুঁকে পড়েন আগন্তুক, পেপার-ওয়েটটা ডান হাতের আঙুলের ভিতর নিয়ে কাচের টেবিলের এক ঘুল্লি দেন, আর সেটা লাট্টুর মতো ঘরঘর করে ঘুরতে থাকে। দিদিমণি ফোন ছেড়ে আগন্তুকের দিকে তাকান। লাট্টুটা তখনও ঘুরে চলেছে। তাঁর মাথাতাও ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। ঘূর্ণায়মান কোনও কিছুর দিকে তাকালেই তাঁর এমনটা হয়ে থাকে। ভাগ্যিস পৃথিবীর ঘূর্ণন দেখতে পান না, নইলে...! একবার ভাবলেন, খপ করে ধরে পেপার-ওয়েটটাকে থামাবেন, পারলেন না। আর তা করাও লাগল না। আগন্তুক নিজেই থামালেন। এখন তাঁর মুঠোর মধ্যেই পেপার-ওয়েটটা, যেন গোটা পৃথিবীটাকে হাতে নিয়ে ভেলকি দেখাতে বসেছেন! এবারে ফের শুরু করলেন:
তো ম্যাডাম, এর থেকেও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, সেদিন দেখি বৃষ্টিতে চারিদিককার সবুজ ধানখেত, উপরের মেঘলা আকাশ, দূরের বাড়িঘর-পুকুর-পাখি-রাজহাঁস সবকিছুর রং কেমন যেন একেবারে ধুয়েমুছে একাকার!
“সে কী?”
“হ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ...! কী বলছি আপনাকে...আর সেইসব বৃষ্টি-ধোয়া গোলা-রং কিনা শেষে চুয়াখাল দিয়ে ভাসতে-ভাসতে চলে যাচ্ছে ইছামতীর দিকে জানেন, আমার প্রিয়তমা কটকটি তখন নীল থেকে বে-নীল, একেবারে ফেনিল ফ্যাকাসে! ওকে দেখে কান্না পেয়ে যাচ্ছিল আমার। আর চারিদিকের বিশাল ওই ধানখেতের সমস্ত সবুজ রং উঠে গিয়ে হালকা কালো রঙের রূপ নিয়েছে। আকাশটাও সাদাকালো!”
“আচ্ছা...আচ্ছা...”
জীবনটা তারপর থেকে সেকালের সাদাকালো টিভির মতোই, জানেন! সব কিছুই তো দেখি তাতে, কিন্তু সবই রঙচঙহীন। এই যেমন আপনি...”
আচমকা থতমত খেয়ে মুখ তোলেন দিদিমণি, সামান্য অবাক! “আমি...?”
“হ্যাঁ, আপিনি! মানে, রাইমা সেনের মতো আপনার মুখটা বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে যেন একেবারে ‘সপ্তপদী’র সুচিত্রা সেন!”  
               রাগে ফেটে পড়বেন, না মুখ টিপে হাসবেনঠিক বুঝতে পারছেন না তিনি। পরিস্থিতি বড়ই বিড়ম্বনার। লোকটা ছিটগ্রস্ত না গাঁজাখুরে? কী বলে যে তাড়িয়ে দেবেন... কৌশলে তাকে না-থামালে এভাবে অনর্গল সুচিত্রা-রাইমার বন্দনা করে যাবে।    
              বাইরে বৃষ্টি হল বেশ। জানলার ওপাশে সন্ধে নেমেছে এখন। দূরের আলোগুলো শার্সির জলে আটকে টিমটিমে তারামণ্ডল যেন। আগন্তুক না-থাকলে আলো নিভিয়ে এই স্লিপিং-চেয়ারটাতেই নিজেকে একটু এলিয়ে দিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে নিতেন হ্যাঁ, একটু-আধটু উত্তম-সুচিত্রা বাজত। তখন এই উটকো উটপাখিটার পরিবর্তে কল্পমেঘের দেশে, পাখপাখালির দেশে, ঘড়ঘড়িয়ে কাঁপতে-থাকা সাদাকালো পরদায় চিরস্মার্টমুখের রোম্যান্টিক-মুহূর্ত ভেসে উঠত খুব, এই পথ যদি শেষ না হয় তবে কেমন হত তুমি বলো তো?...লাল লালালা লা লা...” বাতাসের ওষ্ঠ-অধরে বৃষ্টিসুর লেগে থাকত বেশ কিছুক্ষণ    
              আগন্তুকের প্রশংসাটা কিন্তু বেশ। আরও বেশ হত প্রিয়জন সঙ্গে থাকলে। প্রিয়জন প্রিয়মন আর প্রিয় মেঘেদের মিঞামল্লার সন্তুরবেলায় হৃদয়ে বৃষ্টি নামায় তুমুলকচুপাতার উপর জমা তরল মুক্তো জমতে-জমতে ঢলে পড়ে নীচে উঠোনে আকাশ-জল নেমে-এসে কচিকাঁচাদের মতো লাফায়-ঝাঁপায়-বুদবুদ বানায় খুব টিন-টালির চাল বেয়ে নেমে আসে জলপুঁতিমালা বৃক্ষরাজেদের সাক্ষী রেখে সেইসব মধুমালা পৃথিবীর গলায় প্রণয়-মুহূর্তে পরিয়ে দেয় পাহাড়িয়া আকাশ অবশেষে। শেষমেশ পথ গুটিয়ে এলেও প্রিয়মনে অনুভবের শেষ হয় না কখনও।   
“ম্যাডাম, ও ম্যাডাম!”
            চটক ভাঙেএই এক স্বভাব তাঁর, দ্রুত কোনো কিছুতে মগ্ন হয়ে যাওয়া, ডুবে যাওয়া, তলিয়ে যাওয়া
“হুম, শুনছি। বলুন বলুন!” 
“কী ভাবছেন?”
নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, “আপনার অসুখটা নিয়েই, খুব বিরল কিনা!
“ও হো...বেশ বেশ!”
“আচ্ছা, আপনার বর্ণান্ধতা নেই তো?” 
“না না। সে-সব কিছুই নেই ঠিকইতবে আমি তো এখন কোন মৌলিক রং-ই দেখতে পাই নাএক্ষেত্রে কিন্তু আমাকে বিশুদ্ধ বর্ণান্ধ বলা যায়, কী বলেন?”  
“আপনার সেন্স অব হিউমার কিন্তু বেশ মশাই। এই বিপদের দিনেও...পারেনও বটে। তা কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধে হয় না আপনার, এই যেমন কোনটি কী?” 
“না, একদমই না সাদাকালো টিভিতে আপনার কোনও কিছু বুঝতে অসুবিধে হত কি? কিংবা সাদাকালো সিনেমায়? সেখানে তো চরিত্রেরা ‘দেখো তোমায় গোলাপ দিলেম প্রিয়ে’, ‘দেখো এই আদিগন্ত বনানী’ -সব হামেশাই বলে আমরা তো পরদায় সেই গোলাপ বা বনানীর কালো রং দেখি, কিন্তু কালো রঙে তো ওদের আর কল্পনা করি না, তাই না?”
“ঠিক বলেছেন। যুক্তিটা দারুণ!”
“হে হে, কী যে বলেন!”  
যাইহোক, একটা আই-ড্রপ দিচ্ছি, রাতে শোবার আগে চারফোঁটা লাগাবেন আগামী সপ্তাহের মধ্যে না-সারলে কোনও স্পেশালিস্টকে রেফার করব কিন্তু
“বেশ, তাই-ই করবেন। এক সপ্তাহ ট্রাই করি তবে।”
তাই করুন।”
“হু।”
তাহলে আর কী, শুভ সন্ধ্যা, কেমন! 
“একদম একদম। তো ফির কভি মিলেঙ্গে!”   
 বাব্বা, এন্ট্রি আর এক্‌জিট, সবটাই ফিল্মি! ক’টা ছারপোকায় কামড়েছে কে জানে বাপু!
              লোকটা চলে যেতেই ঘড়িতে চোখ রাখেন দিদিমণি সন্ধে সাড়ে ছয়। আটটায় চেম্বার সেরে উঠে যাবার কথা। বাইরে বেরিয়ে দেখেন, দোকান ফাঁকা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি তখনও। শ্যামদা একমনে বইয়ে মাথাগুঁজে বিড়বিড়িয়ে যাচ্ছেন:

একবার অন্তত
প্রেমিকাকে নিয়ে উড়ে যাও ছাদে...
                              আকাশ গর্ভবতী...


            এই মুহূর্তে শ্যামদাকে বিরক্ত করতে খারাপ লাগছে তাঁর। তবু কিছুক্ষণ পর বলেই ফেললেন, “দাদা, আর তো কেউ নেই মনে হচ্ছে, আজ তাহলে উঠি, কী বলুন!”
যেন বৃষ্টিঅরণ্য থেকে মুখ তুললেন শ্যামসুন্দর হাতে আড়বাঁশি। কবিতায় ডুবে ছিলেন এত সময়। ডুবেই তো ছিলেন, তাই ভাসতে একটু দেরি হল। ভাসতে-ভাসতে দেখেন আকাশ গর্ভবতী! অবশেষে ঘোর কাটিয়ে বলেন, “সাতজন তো ছিল। কিন্তু আর আসবে না বোধহয় কেউ যা বৃষ্টি! চলুন, আপনাকে পৌঁছেদি।
“আমি পারব যে। আপনি বরং পড়ুন।”
“না না। তাই হয় নাকি? আপনার কাছে ছাতাও নেই দেখছি এই ছোটকা, আমি আসছি একটু, দেখিস” পাশের দোকানীকে দায়িত্ব দিয়ে একটা হনুমানছাতার নীচে ম্যাডামকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন টোটো-স্ট্যান্ডের দিকে। দিদিমণিকে টোটোয় তুলে দিয়ে ফিরে এলেন ‘স্বপ্নচর চশমা’য়এসে আবার ডুবদোকানে এত এত চশমা, লোকে আসে, দেখে, কেনে, কিংবা কেনে না অনেকেই তো ফট করে বলে ফেলে:
দাদা, আপনার চোখে দেওয়া চশমাটা বিক্রি করা যাবে?”
“ওইটেই সেরা!”
“কত লাগবে বলুন না আগে!”
“ওটা কিন্তু আপনি লুকিয়ে রেখেছিলেন, খেয়াল করেছি!”
“নিজের জন্য বেছে রেখেছিলেন নাকি?”
“এটা কিন্তু ঠিক নয়!”
“আপনি স্বপ্নচোর!”
“আপনি স্বার্থপর!”
“আপনি...আপনি...আপনি একটা...” বলতে-বলতে কাঁপুনি লেগে যায় ওদের। ডুবে থাকা মানুষ কি আর শুনতে পায় বাতাস-মাধ্যমের এত এত হাহাকার? ফলে খদ্দের ফিরে যায়হাহাকারের অনুরণন বাজতে থাকে ঘরে, ঘর ছাড়িয়ে রেল-স্টেশানের চোঙায়, এমনকি রাস্তার মোড়ে-মোড়েমানুষজন মেয়ে-মডেলের হাতে-ধরা পুরুষের গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া বিশ্বাস করে, মাইক বিশ্বাস করে, দিনভোর চিৎকারের পুনরাবৃত্তি বিশ্বাস করে; বিশ্বাস করে না শুধু নারী ও নদীর অতল বক্ষদেশ আর এই বিপুল অরণ্যবৃষ্টি!   

শিল্পী:চন্দন মিশ্র




                                                       দুই
লোকটাকে ভুলেই গিয়েছিলেন দিদিমণি! ভেবেছিলেন আর আসবে না হয়তো। সাতদিন পার হয়েছে সাতদিন আগেই। এরকম স্ক্রু-ঢিলা কেউ যদি ভিড়ের সময় আসে, তবে সেদিনের মার গেঁড়ে গেল!
             আজ সন্ধে-জানলায় কোনও আলপনা নেই টিমটিমে তারামণ্ডল নেই উত্তম নেই, সুচিত্রা  নেই, রাইমা নেই, রাগরাগিণী নেই। সেই বিকেল চারটে থেকে টানা পেশেন্ট দেখা আছে শুধু। এখনও ঘন্টা দেড়েক থাকতে হবে ভেবে কষ্ট হচ্ছে খুব পেশেন্ট নেই বেশি আর। কিছু পরে ফাঁকা হয়ে এলে আলো নিভিয়ে স্লিপিং-চেয়ারে এলিয়ে পড়েছেন কিছুক্ষণ কানে-কানে চলবে উত্তম-সুচিত্রা।  
              এমন সময় দরজাটা ঈষৎ খুলে যায়। বাইরে থেকে আচমকা আলো এসে দিদিমণির মুখে পড়ে দরজার দিক থেকে দেখলে মনে হবে মুখটা সুচিত্রার মতোই! ম্যডাম আজ শাড়িতেও বেশ। 
             দরজার ফাঁকে সেই ঝাঁকরাচুলোকেই মনে হল দাঁড়িয়ে। হ্যাঁ সেই-ই তো। কী যেন কী নাম?...ওহো রবীন্দ্রনাথ!...আরে আরে ‘শ্রীরবীন্দ্র নাথ আর কী! কিন্তু আজ তাঁর চোখে চশমা নেই কেন? তাঁকে দেখেই হেডফোন সরিয়ে চেম্বারের আলোটা জ্বালেমুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ। চুল-পোশাক দেখে মনে হচ্ছে সমস্যা বেড়ে ছ’গুন। লোকটি উদ্‌বিগ্ন গলায় বলেন, “আসব ম্যডাম?”
আরে, আসুন আসুন!”   
“ডিস্টার্ব করলাম, বলুন?”
“না না। এটা তো আমার পেশা। বলুন, এতদিন কোথায় ছিলেন?”
“পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের সুচিত্রা সেন...” 
 পঙ্‌ক্তিটি শুনে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেনতাহলে এবারে কবিতার পোকাতেও কামড়েছে রবিবাবু-কে!     
“আপনার রঙের কথা বলুন। আই মিন, রঙহীনতা।”
রবিবাবুর মাথাটা নিচু। আরও বিষণ্ন। আরও এলোমেলো। চুলদাড়ি আর কাটেননি বোধহয়। কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর ফের পেপার-ওয়েটটা হাতে নিয়ে এক ঘুল্লি দিলেন। ওটা ঘুরতেই থাকল। পৃথিবী ঘুরছে। এবারে দিদিমণি নিজেই ওটাকে থামালেন। এখন দিদিমণির মুঠোয় পৃথিবীটা।  
“হ্যাঁ, বলুন!”
দিদিমণির কথায় যেন সম্বিৎ ফেরে রবীবাবুর। মুখ তুলে ধীরে-ধীরে বলেন:
“ম্যাডাম, পরশু বিকেলে হঠাৎ যেন মনে হল, এই রঙচঙহীন জীবন রেখে আর কী লাভ? তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, চলে যাব!”
“চলে যাবেন?” দিদিমণির কণ্ঠে চাপা উদ্‌বেগ!
“হ্যাঁ, যাব! আর যাবই যখন, তখন রাজার মতোই যাব। তাই নতুন একটা জামা পরে  রেলবাজার থেকে অমৃতদার ছোলাভাজা-আলুচপ আর বাদামখাজা কিনে চুয়াখালের উপরে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। সেই ক্ষয়ে যাওয়া রেলিং-ধারে। চারিদিকে ধান আর ধান, আর তারই ভিতর এঁকে-বেঁকে চলে যাওয়া চুয়াখাল। কোনও একদিন নাকি সেটি নদী ছিল। নদী মরে খাল। খালও মরে যাবে একদিন। হারিয়ে যাবে ধানখেতের ভিতর। আর আমিও মরে যাব, হারিয়ে যাব। তাই কটকটিকে আড়ালে রেখে সেতুর উপর দাঁড়িয়ে। ও দেখতে পেলে খুব কষ্ট পাবে। আর ঠিক করি, ওই রেলিং থেকেই খালে ঝাঁপ দেব। এখন বর্ষা, এক-দেড়মানুষ জল তো হবেই। চারিদিকে কেউ নেই। সাঁতারও জানি না। জেলেরা ঘরে গেছে। এই নির্জন দুপুরেই কেল্লাফতে!”  
“কী ভয়ঙ্কর! তারপর?” 
“হঠাৎ চোখ বন্ধ করে দিলাম এক বাবরি লাফ! লাফ দিয়েই জলে। জলে হাবুডুবু খাচ্ছি। খাচ্ছি তো খাচ্ছি! নাক-মুখ দিয়ে জল ঢুকছে। জীবনের অতীত থেকে বর্তমানের টেলিকাস্ট শুরু হল ব্রেনের মনিটর-স্ক্রিনে দেখছি নিজেকেই পরপর ঘটনাবিহীন ঘটনায় দেখতে-দেখতে ইন্টারভালে পৌঁছে গেছি। কিন্তু ম্যাডাম, সেদিন বোধহয় ভগবানের ব্যাডলাক ছিল!”
“ব্যাড...লাক..?”
“কেন নয়? হঠাৎ মনে হল চুলের মুঠি ধরে কেউ আমাকে উপরে টেনে তুলছেকে রে তুই? আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কে তোকে অধিকার দিয়েছে টেনে তোলার? শেষে দেখি এক বৃদ্ধ মাঝিআমাকে ডাঙায় তুলেই পেছনে কষে লাথি! বলে, ‘হারামির পো, বউডারে বেধবা করবা? পুলাডারে অনাথ করবা?’ কে কার বউ রে বাবা! বিয়ে করলাম কই আর পুলাই-বা হল কবে? কটকটি শুনেছিল কি না কে জানে! শুনলে ওইখানেই হেসে খুন হত! মাঝখানে পেছনে ঢাকাই লাথিটা খেলাম মিছিমিছি। আমি তখনও বসে-বসে কেশে যাচ্ছি। কেলো বুড়োটা কী যে ক্ষতি করে দিল আমার...! তবু কিছু বলতে পারলাম না। কাশির দমক থামলে একটা বিঁড়ি চাইলাম। বৃদ্ধ দুটো দিলেন। শেষে বিড়ি টেনে আর অমৃতদার ছোলাভাজা আর বাদামখাজা চিবোতে-চিবোতে কটকটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম 
“কী সাঙ্ঘাতিক আপনি!”
“সে না-হয় হল, কিন্তু আমার নতুন চশমাটা তো জলে গেল। পার্সে আপনার প্রেস্ক্রিপশানটাও ছিল, সেটা নেতিয়ে গেল, খসে গেল ফস-ফস করেএখন ছুটতে-ছুটতে আবার এলাম
“তা, আমার কাছে তো না-আসলেও হত, শ্যামদার কাছে বললেই ওই পাওয়ারে নতুন চশমা বানিয়ে দিতেন
“তা দিতেন উনিও সে-কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমি ভাবলাম, আপনাকে একবার দেখাই। ভাবলাম আপনি আজ আসবেন, আগে আসলে ভিড়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধা হতে পারে ফাঁকায়-ফাঁকায় হলে বেশ ভাল হয় আর কী
“তা এলেন কেন? রেফার করব কাউকে? মনে হচ্ছে একজন সাইক্রিয়াটিস্টকে দেখানো উচিত, অ্যাকিউট ডিপ্রেশন অ্যান্ড দেন অ্যাটেম্পট টু কমিট সুইউসাইড!”
“না না। রং নেই, তাই। রং অন তো ডিপ্রেশান গন!”
“তবু...”
“আসলে সেদিন যখন ডুবে যাচ্ছিলাম, ডুবতে-ডুবতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম জীবনের ষোলো রিলের রঙিন সিনেমা। উপরে উঠেও কিছুক্ষণ রঙিন রইল কিন্তু তারপর ধীরে-ধীরে সব আবার আগের মতো সাদাকালো!”  
“কী বলছেন?”
“হ্যাঁ, সেই জন্যেই তো ছুটে-আসা। আপনার ড্রপটায় কাজ দিচ্ছে মনে হল। আর আপইনাকেই চিকিৎসা করতে হবে এখন
“দেখুন রবীন্দ্রনাথবাবু...”
“শ্রীরবীন্দ্র নাথ...শুধু রবিও চলবে 
“আচ্ছা, বেশ। আপনাকে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভাল, আমি কিন্তু চিকিৎসক নই, আমি একজন অপ্টোমেট্রিস্ট, বাংলায় যাকে বলে দৃষ্টি-পরীক্ষক। আমি চোখ পরীক্ষা করে চশমার পাওয়ার দিয়ে থাকিকিন্তু চোখের চিকিৎসা করবেন চক্ষু-বিশেষজ্ঞ। সেজন্যে বলছি, রেফার করব কাউকে? একজন সাইক্রিয়াটিস্টও এক্ষেত্রে আপনাকে হেল্প করতে পারবেন
“বাহ্‌ বাহ্‌ কিয়া বাত! তাহলে তো আপনিই ভালো পারবেন ম্যাডাম। দেখুন আমাদের একটা সাদাকালো প্রটেবল টিভি ছিল পাড়ার লোকজনের সে কী উপচে-পড়া ভিড়, বিশেষ করে শনি-রবির সন্ধ্যায় সিনেমা তখন সেই দু-দিনই। শুক্রবার ছিল বি-টিভি আর বিপাশা হায়াত, দ্য হার্ট-থ্রব! তো বাবা একদি করলেন কী, সামনের নীল কাচ সরিয়ে সেখানে ট্রেনে-বাসে বিক্রি-হওয়া একটা রঙিন কাচ জুড়ে দিলেনব্যস। তারপর থেকে ছবিগুলো মাঝে-মাঝে রঙিন লাগত সাদাকালো টিভি জুড়ে ভাঙাচোরা রঙিন ছবি! তা এমন কিছু চোখের জন্য করা যায় কি?
“না, যায় না
রবিবাবুর চোখেমুখে হতাশাচিহ্ন স্পষ্ট
“তাহলে...কোনও উপায় নেই দেখছি 
“না, নেই। আমার কাছে তো নেই-ই। আচ্ছা, জায়গাটার নাম কী বললেন যেন?” 
“কোন জায়গা?”
 “যেখানে খালটা
“ও...ওটা চুয়াখাল। যাবেন নাকি একদিন বিকেলে? ভারি চমৎকার জায়গা। এখান থেকে টোটো করে মাত্র আধঘন্টা। বলবেন ডুমো-চুয়াখাল যাব। পনেরো টাকা। একবার গেলে মাথা থেকে সুইজারল্যান্ড-ওয়েসেক্স সব ভ্যানিশ হয়ে যাবে ম্যাডাম
“আচ্ছা যাব। কাল সময় হবে আপনার?
“কাল?”
“হ্যাঁ, কাল বিকেল, মানে এই ধরুন বিকেল চারটে?” 
“হবে মানে, আলবাৎ হবে। দরকার হলে কাল ছুটি নেব!” 
“উঁহু, ছুটি নিতে হবে না। তাহলে ছুটির দিনেই হোক
“না না, কাল তো কালই!”
“আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, আপনি জলে ডুব দিলেন, আর তারপর উঠে দেখলেন সব কিছু রঙিন হয়ে গেল?” 
“হ্যাঁ, হল তবে ক্ষণিকের জন্য
“আমি নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখতে চাই, সে-জন্যেই যেতে-চাওয়া আসলে
“তাহলে তো আমাকে আবার ঝাঁপ দিতে হবে!”
“হ্যাঁ, দেবেন আপনি তো তাই-ই চান, তাই না?”
“তা চাই, কিন্তু আপনিও কি তাই চান? একজনের মৃত্যু?”
“ও মা, বাঁচানোর জন্য মাঝি বেচারাকে কত গাল পাড়লেন আপনি, মনে নেই?”  
“বেশ। তবে আমি যে কিছু সময় ধরে রঙিন পৃথিবী দেখব, বা দেখব না, তা কে বলবে আপনাকে?” 
“আপনার বডি তুলে চোখ পরীক্ষা করে জেনে নিতে পারব চিন্তা নেই।”
“কী নিষ্ঠুর! আপনি সুচিত্রা সেন না চিটফান্ড সেন সেইটা আগে বলুন তো ঠিক করে?”  
“তাই নাকি? তবে আমার খুব সুচিত্রা হবার ইচ্ছে হচ্ছে এখন।
“পারবেনই না। আলবাৎ না!”  
“হাঃ হাঃ! বেশ বেশ। আপনাকে ঝাঁপ দিতে হবে না। কিছুই করতে হবে না। ভয় নেই। শুধু আসবেন। এইটুকু। তাহলে কাল দেখা হচ্ছে। পাক্কা?”
“পাক্কা!” 



                                     তিন

এখানে অজস্র ঘুড়িমেঘ উড়ছে আকাশে। লাটাই হাতে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে ওই দূরে কোথাও। অজস্র জলফড়িং ঘাসে-ঘাসেদস্যিমেয়েটা আজও চুল ছেড়ে আকাশেপাখপাখালির ঝাঁক ছবি আঁকছে নৈসর্গিক ক্যালাইডোস্কোপে। ওদের কিচিরমিচির মাটিতে এসে পুনরায় ফিরে যায় আকাশে রবিবাবু বিপুল আলখেল্লায় আকাশপথে মগ্ন হাতে অস্থির তুলি। ধানখেতের মধ্যদিয়ে চুয়াখাল এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহুদূর, শেষে মিশে গেছে ইছামতীর সঙ্গে। খালে কত ভেচাল, ভেচালে মাচা, মাচায় বসে-বসে জেলেরা জাল নামায়, জাল তোলে দিবারাত্রিজালে শিলাবৃষ্টির মতো বিপুল মাছ পড়ে জালে মাছ লাফায়। লাফায় জেলেরাও। পাড়ে দাঁড়িয়ে খালে খ্যাপলাজাল ছুঁড়ে মারছে কেউ কেউ। জাল টানার পর কচিকাঁচাদের সে কী উল্লাস! বাড়ির মেয়ে-বউয়েরাও চলে এসেছে পুরুষদের সাহায্য করতেছোট-ছোট নৌকো, তালডোঙা পাড়ে বাঁধা, মাছধরার জন্যই।
             জায়গাটা সত্যিই দারুণ। চারিদিকে বৃষ্টিভেজা তালখেজুরের শোভা। নববধূর মতো যৌবন ছড়িয়ে পড়েছে গাছে-গাছে ঘাসে-ঘাসে। লোকটা ভুল বলেনি কিছুইখাল এখন জলে টইটম্বুর আজ সকালেও তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। মেঘ করেছে ফের, বৃষ্টি নামবেই।
             এটাই তো সেই সেতু! এই তো কংক্রিট ক্ষয়ে-যাওয়া রেলিং! কথামতো ঠিক সময়ে এসে দাঁড়িয়ে আছেন দিদিমণি, কিন্তু রবিবাবুখনও এলেন না যে! লোকটা কি তবে ভুলে গেল সবকিছু? ভুলতেই পারেন, যা গ্যাদড়া লোক মাইরি!
             টোটোয় এসেছিলেন একাই নেমে টোটোকে ছেড়ে দেন ...কতক্ষণ অপেক্ষা আর? ফোন করলেও লাগে না। টুরুত-টুরুত...বিপবিপ ফুঁস! ...এখানে টাওয়ার-পাওয়াও মুশকিল।
             ... নাহ্‌, আর আশা নেই ...ঘন্টা পার হল যে! পাগল-ছাগল মানুষের পাল্লায় পড়লে আর যা হয়। ...দিদিমণি স্থির করলেন, ফিরে যাবেন ...এক-দু’পা হাঁটাও শুরু করে দিয়েছেন তিনি কতদূর হাঁটতে হবে কে জানে! পথ তো অনেকটাই। তারপর কিছু পাওয়া যাবে তো আদৌ? 
               হঠাৎ দেখলেন, দূরে একটা ধলতা স্কুটার ঠেলতে-ঠেলতে এদিকেই এগিয়ে আসছে কেউদূর থেকেই হাত তুলে চিৎকার, “ম্যাডাম ম্যাডাম...”
               আরিব্বাস, সাদাকালো পরদায় রবিবাবুর এন্ট্রি হল যে! হাঁপাতে-হাঁপাতে প্রবেশ, প্রকৃতির প্রবেশদ্বারে 
“দেরি হয়ে গেল ম্যাডাম ভীষণ ভীষণ দুঃখিত। ফোনের এখানে যা-তা অবস্থা বুঝলেন! আপনাকে খামোখা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল আসলে একশো চার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে খুব অবস্থা খারাপ। কাল ভিজে ভিজে এমন, জানেন!”
“সে কী, আপনার একশো চার জ্বর আর আপনি এখানে?” 
“না না, আমার না আমার না, কটকটির। আপনি যাকে মনে-মনে ধলতা বললেন এই মাত্রকাল বৃষ্টিতে ভিজেই তো ওর ধুম জ্বর। ও-বেটির ভিজলেই এমন হয় স্টার্ট নেয় না কিছুতেইআসছিলাম, তা পথের মাঝখানেই ব্যাগড়া দিতে শুরু করল। প্রথমে যাও-বা এক-দুবার স্টার্ট নিল, পরে তো নিলই না আর। অগত্যা
“তা আমি যে মনে-মনে ধলতা বললাম, আপনি শুনতে পেলেন?”
“হাঃ হাঃ! ছাড়ুন ছাড়ুন! জলে ঝাঁপ দেব কি না সেইটে আগে একবার বলুন!” 
“আরে না না, জলে ঝাঁপ দিতে হবে না। আপনার অকালমৃত্যু হোক চাই না
“রঙহীন জীবনের অর্থ আপনি কী করে বুঝবেন ম্যাডাম? শুধু জীবনটাই আছে, তাকে রোজ টেনে-টেনে ঘ্যাঁসটাতে-ঘ্যাঁসটাতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শুধু!”            
“ঠিক বলেছেন। এইবার আরও ঠিক করে বলুন, এই সেই জায়গাটা তো যেখান থেকে আপনি ঝাঁপ দিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ, ঠিক তাইনিন, আগে ভোলাদার ছোলাভাজা-বাদামখাজা খান। এ-চত্বরে এমনটি আর পাবেন না। ছোলা সেদ্ধ করে তেলে ভেজে পেঁয়াজ-রসুন কুঁচিয়ে বানানো স্পেশাল রেসিপি। নিন, ধরুন আর ঝাল লাগলেই খাজা!
“বাহ্‌, সত্যিই দারুণ তো খেতে! আচ্ছা, নিন, ধরুন, এসে খাচ্ছি বাকিটা, খেয়ে ফেলবেন না কিন্তু! আর আমার এই চশমা আর ব্যাগটাও কাছে রাখুন 
             সেতুর পাশ দিয়ে নেমে-যাওয়া সিঁড়ি দিয়ে ম্যাডাম ধীরে-ধীরে নেমে গেলেন আলতাপা-ডুবজলে। রবিবাবু সেতুর উপরে রেলিং ধরে দু-হাতের উপর ঝুঁকেচুলে তাঁর বিকেলের পড়ন্ত মেঘলা আলো। উপরে পাখিদের ঝাঁকে-ঝাঁকে আকাশ-উড়ান হয়তো এইসব পাখিরা উড়তে-উড়তে ঝাঁকড়া চুলের ছায়ায়-মায়ায় হারিয়ে যাবে একদিন।
              দিদিমণি খালে নেমে দু-হাতের তালুতে জল তুলে চোখে ঝাপ্টা দিতে থাকেন কয়েকবার। আজও শাড়ি পরেশাড়ির ভাঁজে-ভাঁজে বনলতা, লতার ফাঁকে-ফাঁকে সেতার-সানাই আঁকা, তাতেই বুঝি মিঞামল্লার! শাড়িতে মেঘচুল, চুলে কাশফুল, ফুলে কু-ঝিকঝিক সাবেকি ট্রেনের চলে-যাওয়া। আকাশের সাদাকালো পরদায় মিশে যাচ্ছে কালো-কালো ধোঁয়া। “চুল তার কবেকার...” মুগ্ধবোধে রবিবাবু যেন ক্ষণিকের জীবনানন্দ!   
              শাড়িতে সুচিত্রা সেন?
              শাড়ির কিছুটা ভিজে গেল জলে দিদিমণি এবারে মুখ তুলে চাইলেন সেতুর ’পরে, দেখলেন, সেতু থেকে তাঁর দিকে চেয়ে আছে এক উত্তম পুরুষ, পেছনে আলো-মেঘের বোঝা মাথায় নিয়ে হেলে-পড়া সূর্য।
              ধীরে-ধীরে সিঁড়ি বেয়ে সেতুর উপরে উঠে আসেন দিদিমণি
“আপনাকে না পুরো সুচিত্রা লাগছে!” 
“আর আপনাকে অতি উত্তম...”
দুজনেই একসঙ্গে খুব হাসল। খুব...খুউউউব! পাখিগুলোও হাসল বুঝি, একসঙ্গে, ঝাঁকে-ঝাঁকে মেঘগুলোও কি হাসল তবে?
“আসলে রবিবাবু, আমিও রঙহারা বহুদিন কাউকে বলার সাহস পাইনি, আপনি যেমনটি পেরেছেন চুয়াখালের জলে চোখ ভিজিয়ে দেখলাম, বেশ রাঙা লাগছে পুরোনো পৃথিবীকে পৃথিবীর সকল রঙ যেন নতুন করে ওই পেপার-ওয়েটটার মতোই আমার চারিদিকে প্রদক্ষিণ করছে বনবন করে। নতুন লাগছে সবকিছুবোধহয় প্রকৃতির সব ধুয়ে এখানেই জমা হয়েছেকীভাবে কখন যে জীবন থেকে, যাপন থেকে, চোখ থেকে, মন থেকে এক-একটি রং হারিয়ে যায় আমাদের, আমরা তা বুঝতেই পারি না!”   
“ঠিক তাই 
            সারাদিন হারাধন মণ্ডলের মতো মাথায় টোকা পরে দেবাদিদেব মহাদেব লাঙল নিয়ে আকাশটা চষে বেরিয়েছেন। এখন মই দিচ্ছেন শুধুমেঘগুলো মই-দেওয়া মাখনমাটি যেনউপরে থৈ-থৈ জল। এবারে সেই জল গড়িয়ে পড়বে নীচে বুঝি-বা! পাখিদের পিছু-পিছু এসে পড়বে তাল-খেজুর-শিরীষ-আমের উপর। দস্যি মেয়েটাও মায়ের তাড়া খেয়ে চুল থেকে জল ঝেড়ে ফেলবে গামছা দিয়ে।
            খাঁ-সাহেব সন্তুর নিয়ে বসে পড়লেন আবার, সঙ্গতে জাকির হুসেন। সেতার-সানাই? কারা?
            শ্যামদা পুনরায় ডুবে গেলেন অতলে:
প্ররোচনা ঘিরে বাকি রাত শুধু ওড়া!
প্রতি চুম্বনে বেরিয়ে আসুক
            অগ্নিমুখর ঘোড়া...

             তার ব্যক্তিগত চশমা খুলে রাখা পাশে। খদ্দের এসে দেখছে, পরছে, খুলছে, শেষে ঘোড়ার মতো ছুটতে-ছুটতে চলে যাচ্ছে গহিন অরণ্যে। অরণ্যে বৃষ্টি নামছে আবার। আবার বুঝি ডুবে যাবার পালা!          
“ম্যডাম, বৃষ্টি নামছে খুব, চলুন তার আগে বেরিয়ে পড়ি।”  বলতে-বলতেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু। দুজনে দেখল, আকাশ থেকে রঙিন জলশরীর নেমে আসছে এক-এক করে, আর তা মাটিতে পড়া-মাত্রই রং ফিরে পাচ্ছে গাছপালা-মাঠঘাট-পশুপাখি-ঘড়বাড়ি-ঝোপঝাড় বিস্তীর্ণ সাদাকালো ধানখেত এখন সবুজে-সবুজ। রবিবাবু রঙতুলি নিয়ে ফের মেতে ওঠেন আকাশে। রং ফিরে পেয়ে দু-হাত আকাশে মেলে ধরে প্রজাপতির মতো, যেন ইউরেকা, যেন লর্ডসের গ্যালারিতে দাদা! 
             বাতাসে আবার তুখোর মিঞামল্লার
             তবু এই পথ ও তাঁরা দুজন এখনও সাদাকালোবৃষ্টিতে আবার যদি কটকটির একশো চার হয়? কিন্তু কী আশ্চর্য, কিক্‌ মারতেই স্টার্ট!  
“ম্যাডাম, একবার কটকটিতে আসবেন?” 
“আমিও ভাবছিলাম জিজ্ঞাসা করি
“তাহলে আসুন না!” 
            সেই পথে বেয়ে ক্রমশ এগিয়ে যায় ওঁরা তালখেজুরে ঘেরা একটা সুদীর্ঘ আঁকাবাঁকা পথ আরও কিছুটা দীর্ঘ হল আজ ওঁদের ফেলে যাওয়া পথটাও রঙিন হয়ে ওঠে ধীরে-ধীরে। রঙিন হয় ওঁরাও, রাইমা ও উত্তমে। শুধু কটকটি যেন এক অগ্নিমুখর ঘোড়া!   
            পৃথবীর সকল অরণ্য-ঘোড়াগুলোর এবারে আকাশে ওড়ার পালা।  


ঋণ:  বিভাস রায়চৌধুরীর কবিতা ‘ঘোড়া’।  
                        
      
 
শিল্পী: চন্দন মিশ্র 


।। কবিতা আশ্রম ব্লগজিন ।। তৃতীয় সংখ্যা ।। ডিসেম্বর ২০১৮ ।।

শিল্পী: চন্দন মিশ্র                                                           কথা    ফের নকশিকাঁথার ভাঁজ খুলে মাঠে-মাঠে অঘ...