Wednesday 31 October 2018

।। চিতাবাঘের ডাকে ঘুম ভেঙে যেত ( প্রসঙ্গ: যামিনী রায়) ।। সুদীপ বসু ।।

কবিতা আশ্রম-এর জুলাই সংখ্যা ২০১৮ (মুদ্রিত) থেকে:  


                              চিতাবাঘের ডাকে ঘুম ভেঙে যেত
                                    (প্রসঙ্গ:যামিনী রায়)  
                                                    সুদীপ বসু



কলকাতা: জীমূত চলে গেল...
যামিনী: ওই কথাটা তুলো না...ওর কথা ভাবলে আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে...আমার মাথার সব কোষগুলোও ঠোকাঠুকি শুরু করে দেয়------
কলকাতা: জীমূতের মৃত্যুর জন্যে তুমি কি কিছুটা নিজেই দায়ী?
যামিনী: জানি না (কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে)...একেবারেই জানি না...দারিদ্র্য ছিল...চরম দারিদ্র্য ছিল তখন...সেই ট্রাঞ্জিসন পিরিয়ডটায়...পোর্ট্রেট ছেড়ে নিজের চিত্রভাষা খুঁজে বেড়াচ্ছি...সংসারের প্রতি চরম অবহেলা করেছি তখন...সেই সময়টায়...ধর্ম, জীমূত ওদের এক জায়গায় মুড়ি কিনে দিতাম সারা দিনের খাবার জন্যে...রবীন্দ্রনাথ সেই সময় বলেছিলেন আমার স্ত্রীকে ‘যামিনী যে পথ নিয়েছে তাতে তো তোমাদের দুজনের একবস্ত্রে থাকার কথা।’ ...সত্যিই সেইরকমই দিন গেছে আমাদের তখন।
কলকাতা: কিন্তু জীমূত তো চলে গেল আরও পরে? তখন তো তুমি অনেকটা দাঁড়িয়ে গেছ তোমার নতুন চিত্ররীতি নিয়ে?
যামিনী: সেটাই আশ্চর্য! ...তখন তো আমাদের দারিদ্র্য একটু-একটু করে সরে যাচ্ছে ...যুদ্ধের জন্যে আসা সৈন্যিকেরা আমার ছবি কিনছে একটু-আধটু...”
                                         ( যামিনী কলকাতা সাক্ষাৎকার: সঞ্জয় ঘোষ )

             বাঁকুড়া জেলা। গ্রাম বেলিয়াতোড়। গ্রামদেশের প্রাচীন অন্ধকার। প্রাগৈতিহাসিক পশুর মতো হিংস্র রহস্যময় আর কালো। রাতে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে শিশুটি ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদে। তাঁর ঘুম আসে না। কষ্টে নয়, আতঙ্কে। আতঙ্কও তো একধরণের শারীরিক কষ্ট। গ্রামের শেষ সীমানায় মাটির বাড়ি। পাশেই বেলিয়াতোড়ের গভীর জঙ্গল। সন্ধের পর অন্ধকার নামলেই সেখান থেকে ভেসে আসে হাতির ডাক, শেয়ালের তীব্র চিৎকার, চিতাবাঘের গর্জন। ভয়ে হাড় হিম হয়ে যায়। বাবা সারারাত গোয়ালে হিংস্র পশুর কবল থেকে গোরু-মোষগুলিকে পাহারা দেন লাঠি হাতে। শিশুটি আধোঘুমে ভয়ে চিৎকার করে উঠলে তিনি দৌড়ে আসেন ঘরে। শিশুটিকে সান্ত্বনা দেন, ‘ভয় নেই, এই দ্যাখো আমার হাতে রামদা, কেউ কাছে এলেই কোপ বসিয়ে দেব।’ তবু তার ভয় যেন আর যায় না।
               যায়ওনি। পরে সে যখন ধীরে-ধীরে বড় হয়েছে, সংসারী হয়েছে, কাজপাগল উন্মাদ শিল্পী হয়েছে, যামিনী রায় হয়েছে, তখনও এই জঙ্গল তাঁর মধ্যে নিরন্তর ছায়া ফেলে গেছে। এই অন্ধকারের আতঙ্ক, জন্তুজানোয়ারের অবসেশান শুধু যে যামিনী রায়ের জীবন আর শিল্পকর্মেই বারবার দেখা দিয়ে গেছে তা নয়, তাহলে তো তাও একরকম স্বাভাবিক ব্যাপারই হত, জীবনের একটা চরম সংকটের সময়ে তা যেন তাঁর নিয়তি হয়ে উঠল। আর জন্ম নিল শিল্পীর জীবনের সবচেয়ে রক্তাক্ত ক্ষতস্থান, জীবনের জমারক্ত।
              অসামান্য পোর্ট্রেট আঁকতেন যামিনী রায়। পোর্ট্রেট এঁকে তখন তাঁর খুব নামডাক। পোর্ট্রেটের বিক্রি আছে দারুণ। তাছাড়া ফরমায়েসী পোর্ট্রেট এঁকে রোজগার আরো ভালো। একজন চিত্রশিল্পীর জীবনে একে প্রাচুর্যই হয়তো বলা যায়।
              কিন্তু একজন জাতশিল্পীর কাছে পোর্ট্রেট এঁকে জীবিকানির্বাহ আর সরকারি করণিকের চাকরি করে রোজগার করা তো হরেদরে একই। এমন আর্থিক স্বচ্ছলতা সাধারণ মানুষকে আত্মতুষ্টি জোগায়, কিন্তু প্রকৃত শিল্পীকে আত্মধিক্কারে আচ্ছন্ন করে। স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও সন্তুষ্টি ছিল না যামিনী রায়ের। নতুন ছবির ভাষায় যে ক্ষুধা তাঁর আজন্মকালের, তা যেন আর প্রবলশক্তিতে আক্রমণ করল তাঁকে, এই সময়ে। তাঁর বাবা সরকারি চাকরির নিশ্চয়তায় ভরা সুখের সময় হঠাৎ খারিজ করে দিয়ে পরিবার নিয়ে বেলিয়াতোড়ের গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। গিয়ে জীবনকে স্বেচ্ছায় আরো বিপন্ন করে তুলেছিলেন। যামিনী রায়ের শিরায়-শিরায় তো সেই রক্তেরই তোলপাড় ছিল। তিনিও আকস্মিকভাবে পোর্ট্রেটের কাজ ছেড়ে নতুন চিত্রভাষার নতুন ডিকশনের সন্ধানে নেমে পড়লেন, ফলে অচিরেই চরম দারিদ্র্যের ভেতর ডুবে গেল তাঁর সংসারঅর্থ নেই, অন্ন নেই, বাড়িভাড়ার সংকুলান নেই। বাড়িওয়ালার চাপে এক উত্তর কলকাতার অঞ্চলেই বাড়ি বদলাতে হল কতবার। এক পয়সার মুড়ি, একটা সময় গেছে, যখন এইটুকুই ছিল তাঁর দুই ছেলে ধর্মদাস ও  জীমূতের সারাদিনের খাদ্য।
সুদীপ বসু 

                কিন্তু বড় শিল্পীর নিয়তি বোধহয় এইটিই। বিপন্নতা থেকে পেরিয়ে এসে আরো এক নতুন ও বড় বিপন্নতার ভেতর প্রবেশ করবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। ধীরে-ধীরে তাঁর এই নতুন ছবির সমঝদার জুটতে লাগল। ছবি বিক্রি হওয়াও শুরু হল এক-আধটা। আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার, যুদ্ধের সময় যেসব সৈন্যদের ক্যাম্প পড়ত কলকাতায়, তারাও যেচে এসে পয়সা খরচ করে তাঁর ছবি কিনে নিয়ে যেতে শুরু করল। যুদ্ধের লণ্ডভণ্ড অনুভূতির ভেতর তাঁর ছবি তাঁদের দু-দণ্ড স্বস্থি দিত হয়তো।

কলকাতা: জীমূতের তো শিল্পী হওয়ার ইচ্ছে ছিল------তবে কেন দোকানে বসে সময় নষ্ট করতে দিলে?
যামিনী: এখন ভাবি হয়তো ঠিক করিনি...আমার বড়ো ছেলে ধর্ম ওটা মেনে নিয়েছিল...জীমূত হয়তো মন থেকে মেনে নিতে পারেনি পুরোটা...মাঝে-মাঝে ওকে যেন কেমন বিষণ্ণ দেখতাম...তখন অবশ্য আমার ওসব লক্ষ করবার মতো সময় ছিল না বিশেষ...ছবির ভাষা নিয়ে ক্রাইসিসে ভুগছি তখন দিনরাত...ছবির বিক্রি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। জীমূত একটু বেশি সেনসিটিভ ছিল...ওকে হয়তো আমার আরও অনেক নজর দেওয়া উচিত ছিল...”                                                                                                                          (যামিনী কলকাতা সাক্ষাৎকার: সঞ্জয় ঘোষ )

                একটা দিকচিহ্নহীন ধূ-ধূ বিজনপ্রান্তর। কয়েকটি শাল-পিয়াল ও বটের ঝুরি ছড়িয়ে আছে মাঠময়। একপাল শুয়োর সেই শুকনো পাতা চূর্ণ করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। সেই অলৌকিক নির্জনতায় পাতাভাঙার যে মর্মরধ্বনি, তা যেন ছবি ফুটে বের হয়ে আসছে।
                জীমূতের আঁকা ছবি। জীমূত ছিল আর্টিস্ট। অসম্ভব শক্তিশালী আর্টিস্টতাঁর ধারণা যামিনী রায়ের ঘরানার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছিল। হয়তো সেই কারণেই যামিনী চেয়েছিল জীমূত তাঁর সহকারী হয়ে থাকুক আজীবন, তল্পিবাহক হয়ে থাকুক। তাঁর ছবির প্রতি তাঁর ছিল চরম উদাসীনতা অথবা ভাষান্তরে অনীহা। পাড়ার মোড়ে দুই ছেলের জন্য মুদির দোকান করে দিয়েছিলেন যাতে তাঁরা নিজেদেরটা নিজেরাই বুঝে নিতে পারে। বড় ছেলে ধর্মদাস এটা সহজভাবে মেনে নিয়েছিলেন। টানাটানির সংসারে এটাই তো ভবিতব্য।
                  জীমূত পারেনি। জন্ম-আর্টিস্ট জীমূত। জন্মবিপ্লবী জীমূত। বড়দার মতোই বিপ্লবী দলে নাম লেখাল সে। কিন্তু ধর্মদাসের ব্যাপারটা জানতেন যামিনী রায়। বহুবার তাঁকে মানা করেছিলেন বিপ্লবীদলের সঙ্গে মিশতে, সন্ত্রাসবাদী বইপত্তর পড়তে। কিন্তু স্বল্পভাষী, অন্তর্মুখী জীমূত বিপ্লবীসঙ্গ করত গোপনে, বাবার সম্পূর্ণ অজান্তে। তাঁকে নিষেধের অবকাশ পাননি যামিনী।

কলকাতা: জীমূতের ঘটনাটা কী করে ঘটল?
যামিনী: তার দু-দিন আগে ও বলল, কলকাতায় আর ভাল্লাগছে না...আমি দু-দিন বেলিয়াতোড়ে ঘুরে আসি...না বললাম না...সঙ্গে ওর দুজন বন্ধুও গেল...
কলকাতা: হয়তো সেই সময় ওর চোখের দিকে তাকানোর তোমার সময় হয়নি রেখা ও রঙের সম্পর্ক নিয়ে তুমি তো খুব ব্যস্ত ছিলে তখন।
যামিনী:র চোখের দিকে কোনোদিনই আমি তেমন তাকাইনি বোধহয়...ও চলে যাবার ৫-দিন পরেই দুঃসংবাদটা পেলাম...ট্রাঙ্ককলে...আমার একজন খুড়তুতোভাই ফোন করল বেলিয়াতোড় থেকে                                                                                                                         ( যামিনী কলকাতা সাক্ষাৎকার: সঞ্জয় ঘোষ )

           আত্মহত্যা নয়জীমূত এর আগে একবার ( মতান্তরে দু-বার) আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। সে অন্য কথা। এবারকার ঘটনাটা সম্পূর্ণ অন্যরকম এবং অদ্ভুত। বাবার অনুমতি নিয়েই জীমূত বেলিয়াতোড় গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। মানসিক অবসাদ আর শহরের নিরবচ্ছিন্ন একঘেয়ে জীবনযাপন তাঁকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে এইটুকু জানা যায় যে, জীমূত যখন তাঁর দুই বন্ধুর সঙ্গে গভীর জঙ্গলে ঢোকে, সূর্য তখন প্রায় মধ্য-আকাশে। বিকেলের মুখে দুই বন্ধু জঙ্গল থেকে ফিরে এল। কিন্তু জীমূত এল না। বিকেল ফুরিয়ে এল। জঙ্গল আচ্ছন্ন হয়ে গেল প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে।
              পরেরদিন আলোয় গ্রামের মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজতে বেরোল জীমূতকে। অবশেষে জঙ্গলের ভেতর একটা ডোবার ধারে পাওয়া গেল জীমূতের স্তব্ধ মরশরীর। মুখ ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। হাতে-পায়ে এমনকী গোটা গায়ে আঁচড়ানো-কামড়ানোর নৃশংস চিহ্ন।
              কে বা কারা মারল জীমূতকে? বন্যপশু না বুনো মানুষ? সন্তাসবাদী দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলই জঙ্গলের পথে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিত খুন নয়তো? তারপর বন্যজন্তুর নাগালে মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যাওয়া? নাকি নিছকই দুর্ঘটনা, ক্ষুধার্ত জানোয়ারের তাণ্ডব? ঐ দুই বন্ধুই-বা তাঁর খোঁজখবর না-করে ফিরে এল কেন? কেনবই-বা তারা অনুসন্ধানের কাজে বিশেষ একটা হাত লাগালেন না? সেই রহস্য আজও অস্পষ্ট থেকে গেছে। খবর পেলেন কিন্তু বেলিয়াতোড় গেলেন না যামিনী রায়। দু-দিন পর গ্রামের শ্মশানেই জীমূতের দাহকাজ হয়ে গেল।
             শুধু তুলি থেমে গেল তাঁর। ফাঁকা ক্যানভাসের সামনে বসে থাকতেন ঘন্টার-পর-ঘন্টা, দিনের-পর-দিন, রাতের-পর-রাত। আঁকার কোনো তাড়নাই ছিল না তাঁর। ধীরে-ধীরে গভীর অবসাদে ডুবে গেলেন যামিনী রায়। অবসাদে? না তীব্র মনোকষ্টে? অপরাধবোধে? না কি আতঙ্কে?
             শৈশবের সেই জঙ্গলের অবসেশন এতবছর পর মেজোছেলের মৃত্যুর কাঁধে ভর করে ফিরে এল নাকি?


শিল্পী: চন্দন মিশ্র 

No comments:

Post a Comment

।। কবিতা আশ্রম ব্লগজিন ।। তৃতীয় সংখ্যা ।। ডিসেম্বর ২০১৮ ।।

শিল্পী: চন্দন মিশ্র                                                           কথা    ফের নকশিকাঁথার ভাঁজ খুলে মাঠে-মাঠে অঘ...