Wednesday 31 October 2018

।। ছোটগল্প:ঘোড়া।। অমিতকুমার বিশ্বাস ।।

কবিতা আশ্রম-এর জুলাই সংখ্যা ২০১৮ ( মুদ্রিত) থেকে:  

ছোটগল্প



                                 ঘোড়া   
                                     অমিতকুমার বিশ্বাস

মায়ের বকুনি উপেক্ষা করে ষোড়শী মেঘগুলো ভূতশিরীষের উপর চুল খুলে বসে পড়েছে সহসা। বিকেল ক্রমশ বিলীনপথে। শ্রাবণ তেমন আর গর্জায় না আজ, তবে বর্ষায় রিমঝিম-রিমঝিম অবিরাম কাছে-দূরের তমালতরুদেশে শুধু বর্ষায় আর বর্ষায়, যেন মিঞামল্লারে ক্ষেপেছে খাঁ-সাহেবের আপন সন্তুর।  
            এবেলা আর কোনও পেশেন্ট নেই ঘরের আলোটা নিভে আসে। শার্সি থেকে পরদা সরানোয় বাইরের আলোপথ খুলে যায় জানলায় বৃষ্টিলিপি। এই প্রণয়মধু-মরসুমে আকাশ থেকে মাটির দেশে বেড়াতে-আসা জলকন্যারা কাচবিছানায় একে-একে অলঙ্কারসমূহ সরিয়ে নির্ভার হয় চিরায়ত প্রেম ও প্রকল্পের কাছে বাতাসের ধ্যান ভাঙে। মৃদু আঙুল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে একাকী বাতাস আলপনা দেয় আপন খেয়ালে কখনও সে জলহরিণের ছদ্মবেশে ছুটে যায় হরিণীর পিছে-পিছে কখনও-বা হৃদর-বাঁশিতে দেয় এক ফুঁ দুই ফুঁ, সঙ্গে-সঙ্গে সুর ও শীৎকার ওঠে মহাকাশে ধীরে-ধীরে একটা জলকণা আর-একটার খুব কাছে আসে, দৃঢ় আলিঙ্গনপাশ-ইচ্ছেতে যেন, যেন মহাবিচ্ছেদের বহুযুগ পর কিংবা তার কিছু আগেই! কম্পিত অধর আরও একটু কম্পিত মৌনমুখরতা যা কিছু সবই বৃষ্টিলিপি জানেঅযথা কথা নয় তাই আজ আর একটিও। আলোও নয়। কথাদূষণ-আলোদূষণে ঘষে যায় খসে যায় হৃদয়ের সকল করমচা-রং। এইসব ভেঙে যাওয়া ধ্যানের ভিতর, প্রেম আর খিদের ভিতর, স্বপ্নগর্ভের ভিতর একটু-একটু করে বাড়তে থাকে আমাদের শকুন্তলাবন্যপ্রভা। একটু-একটু করে বাড়তে-বাড়তে সে-প্রভা উন্মুক্ত হয় অরণ্যআশ্রমগৃহে। শেষেমেশ বৃষ্টি ও বাতাসের অনিবার্য বিচ্ছেদের পর অরণ্য চুপিচুপি বলে ওঠে, আয় খুকি, আয় লুসি, আয় আমাদের নগর-উপেক্ষিত চিরায়ত প্রেম-বিরহের আপন অরণ্য-উপাখ্যান।” নেপথ্যের শ্যামসুন্দরমধুমালা বৃষ্টির গায়ে আছড়ে-আছড়ে পড়ে; খামচে-খামচে ধরে কাচশরীর:
যদি বৃষ্টির রাতে
বাড়ি ফিরবার রাস্তাকে মনে হয়
কান্নায় ভিজে আছে...

দোলনচাঁপার গন্ধের ভূমিকাকে
তুচ্ছ করতে পারছে না কিছুতেই,
মৃত্যুর মতো অসহ্য লাগছে...

দরজা-জানলা ভেঙে ফেলো, বন্ধু!

ধুয়ে-মুছে যাক ক্ষত।   

“আসতে পারি?”
আচমকা ক্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ- শব্দের পেছন-পেছন প্রলম্বিত জিজ্ঞাসা-চিহ্ন! ঘোর ভাঙে দিদিমণির ঈষৎ খোলা-দরজা দিয়ে দোকানের আলো আগন্তুকের কাঁধের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঝাঁকরা চুলে জলের ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি তাঁর চশমাতেও ফট করে আলো জ্বালেন দিদিমণি আগন্তুকের মুখের দিকে না-চেয়েই যান্ত্রিক আন্তরিকতায় উত্তর ছোঁড়েন, “আসুন!  
             মাথা ভর্তি বৃষ্টি নিয়ে আগন্তুক ঝটপট ঢুকে পড়ে চেম্বারে, যেন এক ভেজা দাঁড়কাক হঠাৎ কার্নিশ পেয়ে বার-কয় দ্রুত ডানা ঝাপটায়, তারপর চুপিটিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ফের ঝাপটাবে? ঘরের আলোয় আগন্তুকের মুখটা এবারে বেশ বোঝা যায় স্পষ্ট দিদিমণি মনের হাই-মেগাপিক্সেলে পটাপট ছবি তুলে নেন মুহূর্তেই মধ্য-যৌবনের পুরুষ। মুখে এক হপ্তার গোঁফ-দাড়ি টিকালো নাকের ’পর মানানসই রিমলেস রং ও উচ্চতায় সত্তর দশকের বাঙালি শরীরে সবে মেদসঞ্চয় শুরু পোশাক ও হাভভাবে মনে হয় কোনও কর্মঅলস সরকারি দপ্তরে বেশ কয়েক বছর কেরানির পদ সামলাচ্ছেন। 
“বসুন
গদিহীন চেয়ারে খুব সাবধানে বসে রুমাল দিয়ে মাথা-মুখ-চশমা মুছতে-মুছতে নিজে থেকেই শুরু করলেন, “আসলে অনেকদিন চোখ পরীক্ষা করাইনি তো...”
“ও, আচ্ছা চশমাটা খুলুন...বেশ বেশ। নিন, এবারে এটা পরুন” নিজেই ট্রায়াল-ফ্রেমটা আগন্তুকের নাকের ’পর বসিয়ে দিলেন দিদিমণিতারপর তাতে ট্রায়াল-বক্স থেকে নানান পয়াওয়ারের লেন্স একে-একে বসিয়ে স্নেলেনের চার্টের দিকে তাকাতে বলেনডান চোখ, বাম চোখ, ক্রমে দু-চোখ দিয়ে একসঙ্গেপরে কাছের চার্টও  সামনে মেলে ধরেন
“দেখুন তো!” 
“একটু ঝাপসা
“এইবার?”
“একটু কম
 “এইবার?” 
 “হ্যাঁ হ্যাঁ, এইবার...এইবার একদম ক্লিয়ার ম্যাডাম, একদমই...” 
             দেরি না-করে প্যাডে খচাখচ পাওয়ার লিখে বলেন, নামটা কী যেন...
“নাম? ওহো, নাম কি লিখতেই হবে?”
কলমটা থামিয়ে মুখটা তুললে আগন্তুন যেন ঘাবড়ে যান। অগত্যা আগন্তুক বলেন, “...বেশ তো, লিখুন না, নাম...আজ্ঞে নাম হল শ্রীরবীন্দ্রনাথ...”
নামটা শুনেই বেদম হাসি পায় দিদিমণির প্রথমত নামের আগে ‘শ্রী’। এখন তো আর কেউ এমন বলেন না, লেখেনও না, নিজের বেলাতে তো নয়ই তার উপর আবার ‘রবীন্দ্রনাথ’! এরপর হয়তো পদবিটা ‘ঠাকুর’ না বলে বসেন! না, একদমই হাসা যাবে না পেশেন্টের সামনে। তাতে নিজের পেশাদারী ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
“পুরো নাম?”
“বাবার নাম বলতে হবে নাকি আবার?”
“তা কেন? নিজের পুরো নামটাই বলুন না, আই মিন পদবি-সহ
“ওহো, আমি ভাবলাম, ‘নাম বিজয় দীনানাথ চৌহান, পুরানাম বাপকা নাম দীনানাথ চৌহান...’, হে হে...ম্যাডাম, আমার পুরো নাম শ্রীরবীন্দ্র নাথ। ‘শ্রীরবীন্দ্র’ হল আমার নাম, আর পদবিটা ‘নাথ’ 
“ও হো! আচ্ছা আচ্ছা! বেশ ইন্টারেস্টিং! আর বয়স?”
“...উমর ছত্তিশ সাল ন’ মাহিনা আট দিন...”
“আরে থামুন থামুন! ঐ ছত্রিশেই হবে। তা আপনার ফিল্মেটিল্মে সখ আছে বুঝি?”
“সে তো আপনারও আছে
              পেশেন্টের সঙ্গে অযথা বেশি কথা না-বলাই ভালো, কী বলতে আবার কী বলে ফেলবেন!
“আচ্ছা বেশ, আসুন তবে নতুন চশমা বানিয়ে পাওয়ার চেক করিয়ে নিয়ে যেতে পারেন
“আচ্ছা ম্যাডাম, একটা কথা ছিল, বলব? বলতে কিন্তুড্ড সংকোচ-বোধ হয়। এর আগে দুজনকে বলেছিলাম, তাঁরা আসলে বিশ্বাস করেননি কেউ
            এই সেরেছে! আবার কী বলবেন ভদ্রলোক? বলতে না-দিয়েও তো উপায় নেই! কী এক উটকো ঝামেলা এই বৃষ্টিদিনে  
“আচ্ছা বলুন সংক্ষেপে আমার উঠে যাবার সময় হয়েছে কিন্তু
“এই বৃষ্টিতে?”
ঝুঁকি বুঝে কোনও উত্তর দিলেন না। বরং স্মার্টফোনে মিথ্যে-মগ্নতার মধ্য দিয়ে প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করতে লাগলেন।
“ম্যাডাম, গত বছর বর্ষার পর-পরই আমি এক ঘোর সমস্যায় পড়েছি 
“সমস্যাটা বলুন
“আপনি বিরক্ত না-হলে একটু খুলে বলি?”
বিরক্ত তো হচ্ছেনই। ঘোর বিরক্ত। তার উপর আবার কিনা খুলে! কাট-পিসটাকে সরাতে হবে দ্রুত। তাই স্ক্রিনে চোখ রেখেই নীরস কণ্ঠে বলেন, “হুম। বলুন
“আসলে প্রতিদিন বিকেলের মতোই সেদিন ডুমোবাঁওড়ের দিকে কটকটিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছি...
“ক-ট-ক-টি?”
“আমার স্কুটার
“ও, আ-চ্ছা!”
“তো, রাস্তাটা পাকা দু-পাশে বিস্তীর্ণ ধানখেত। কিছুদূর গিয়ে চুয়াখালের উপর দাঁড়িয়ে আমিহঠাৎ ঝমঝম বৃষ্টি। গত বর্ষার সেই প্রথম জানেন, ভিজতে কিন্তু ভালোই লাগছিল!
“তো?”
তো হঠাৎ খেয়াল করি, সেতুর উপর যে সিমেন্টের রেলিং ছিল, সেগুলো ওই বৃষ্টির ঝাপটায় খসে-খসে লোহার রডগুলো একদম হাঁ হয়ে যাচ্ছে   
“কী কাণ্ড!” দিদিমণির বুড়ো আঙুলের নীচে তখন হাওড়া ব্রিজমিতালি বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে ছবি পোস্টিয়েছে সবে। “আবার একটা? পারেও বটে!” মনে-মনে বলে ওঠেন। শেষে চট করে অনিচ্ছের আঙুল-স্পর্শে লাইকান। কাণ্ডই বটে!” এবারে আগন্তুকের কথায় বিরক্ত হয়ে ফের মনে-মনে বিড়বিড়ানো। এখন এই বৃষ্টিতে তাঁকে কিনা শেষে  এই গাঁজাখুরি গল্পটাও শুনতে হচ্ছে? কী আপদ রে বাবা!
“ম্যাডাম, পিকচার আভি বাকি হ্যাঁয়!”
মেরেছে রে! আবার? ফিল্মি ছারপোকাটাকে সিনেমা-হল থেকে হেঁটে সটান এখানেই হেঁটে আসতে হল?
“নিন, বাকিটাও বলুন, কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি!”  
হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম একদম।”
দিদিমণি আঙুল ঠেলে রবীন্দ্রসেতুটা সরানোর চেষ্টায়। তবু চোখ আটকে আছে মিতালিদের দিকে। ছেলেটাকে বড্ড চেনা-চেনা লাগছে তাঁর। কিন্তু...এদিকে দিদিমণিকে অন্যমনস্ক দেখে টেবিলে ঝুঁকে পড়েন আগন্তুক, পেপার-ওয়েটটা ডান হাতের আঙুলের ভিতর নিয়ে কাচের টেবিলের এক ঘুল্লি দেন, আর সেটা লাট্টুর মতো ঘরঘর করে ঘুরতে থাকে। দিদিমণি ফোন ছেড়ে আগন্তুকের দিকে তাকান। লাট্টুটা তখনও ঘুরে চলেছে। তাঁর মাথাতাও ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। ঘূর্ণায়মান কোনও কিছুর দিকে তাকালেই তাঁর এমনটা হয়ে থাকে। ভাগ্যিস পৃথিবীর ঘূর্ণন দেখতে পান না, নইলে...! একবার ভাবলেন, খপ করে ধরে পেপার-ওয়েটটাকে থামাবেন, পারলেন না। আর তা করাও লাগল না। আগন্তুক নিজেই থামালেন। এখন তাঁর মুঠোর মধ্যেই পেপার-ওয়েটটা, যেন গোটা পৃথিবীটাকে হাতে নিয়ে ভেলকি দেখাতে বসেছেন! এবারে ফের শুরু করলেন:
তো ম্যাডাম, এর থেকেও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, সেদিন দেখি বৃষ্টিতে চারিদিককার সবুজ ধানখেত, উপরের মেঘলা আকাশ, দূরের বাড়িঘর-পুকুর-পাখি-রাজহাঁস সবকিছুর রং কেমন যেন একেবারে ধুয়েমুছে একাকার!
“সে কী?”
“হ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ...! কী বলছি আপনাকে...আর সেইসব বৃষ্টি-ধোয়া গোলা-রং কিনা শেষে চুয়াখাল দিয়ে ভাসতে-ভাসতে চলে যাচ্ছে ইছামতীর দিকে জানেন, আমার প্রিয়তমা কটকটি তখন নীল থেকে বে-নীল, একেবারে ফেনিল ফ্যাকাসে! ওকে দেখে কান্না পেয়ে যাচ্ছিল আমার। আর চারিদিকের বিশাল ওই ধানখেতের সমস্ত সবুজ রং উঠে গিয়ে হালকা কালো রঙের রূপ নিয়েছে। আকাশটাও সাদাকালো!”
“আচ্ছা...আচ্ছা...”
জীবনটা তারপর থেকে সেকালের সাদাকালো টিভির মতোই, জানেন! সব কিছুই তো দেখি তাতে, কিন্তু সবই রঙচঙহীন। এই যেমন আপনি...”
আচমকা থতমত খেয়ে মুখ তোলেন দিদিমণি, সামান্য অবাক! “আমি...?”
“হ্যাঁ, আপিনি! মানে, রাইমা সেনের মতো আপনার মুখটা বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে যেন একেবারে ‘সপ্তপদী’র সুচিত্রা সেন!”  
               রাগে ফেটে পড়বেন, না মুখ টিপে হাসবেনঠিক বুঝতে পারছেন না তিনি। পরিস্থিতি বড়ই বিড়ম্বনার। লোকটা ছিটগ্রস্ত না গাঁজাখুরে? কী বলে যে তাড়িয়ে দেবেন... কৌশলে তাকে না-থামালে এভাবে অনর্গল সুচিত্রা-রাইমার বন্দনা করে যাবে।    
              বাইরে বৃষ্টি হল বেশ। জানলার ওপাশে সন্ধে নেমেছে এখন। দূরের আলোগুলো শার্সির জলে আটকে টিমটিমে তারামণ্ডল যেন। আগন্তুক না-থাকলে আলো নিভিয়ে এই স্লিপিং-চেয়ারটাতেই নিজেকে একটু এলিয়ে দিয়ে কানে হেডফোন গুঁজে নিতেন হ্যাঁ, একটু-আধটু উত্তম-সুচিত্রা বাজত। তখন এই উটকো উটপাখিটার পরিবর্তে কল্পমেঘের দেশে, পাখপাখালির দেশে, ঘড়ঘড়িয়ে কাঁপতে-থাকা সাদাকালো পরদায় চিরস্মার্টমুখের রোম্যান্টিক-মুহূর্ত ভেসে উঠত খুব, এই পথ যদি শেষ না হয় তবে কেমন হত তুমি বলো তো?...লাল লালালা লা লা...” বাতাসের ওষ্ঠ-অধরে বৃষ্টিসুর লেগে থাকত বেশ কিছুক্ষণ    
              আগন্তুকের প্রশংসাটা কিন্তু বেশ। আরও বেশ হত প্রিয়জন সঙ্গে থাকলে। প্রিয়জন প্রিয়মন আর প্রিয় মেঘেদের মিঞামল্লার সন্তুরবেলায় হৃদয়ে বৃষ্টি নামায় তুমুলকচুপাতার উপর জমা তরল মুক্তো জমতে-জমতে ঢলে পড়ে নীচে উঠোনে আকাশ-জল নেমে-এসে কচিকাঁচাদের মতো লাফায়-ঝাঁপায়-বুদবুদ বানায় খুব টিন-টালির চাল বেয়ে নেমে আসে জলপুঁতিমালা বৃক্ষরাজেদের সাক্ষী রেখে সেইসব মধুমালা পৃথিবীর গলায় প্রণয়-মুহূর্তে পরিয়ে দেয় পাহাড়িয়া আকাশ অবশেষে। শেষমেশ পথ গুটিয়ে এলেও প্রিয়মনে অনুভবের শেষ হয় না কখনও।   
“ম্যাডাম, ও ম্যাডাম!”
            চটক ভাঙেএই এক স্বভাব তাঁর, দ্রুত কোনো কিছুতে মগ্ন হয়ে যাওয়া, ডুবে যাওয়া, তলিয়ে যাওয়া
“হুম, শুনছি। বলুন বলুন!” 
“কী ভাবছেন?”
নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, “আপনার অসুখটা নিয়েই, খুব বিরল কিনা!
“ও হো...বেশ বেশ!”
“আচ্ছা, আপনার বর্ণান্ধতা নেই তো?” 
“না না। সে-সব কিছুই নেই ঠিকইতবে আমি তো এখন কোন মৌলিক রং-ই দেখতে পাই নাএক্ষেত্রে কিন্তু আমাকে বিশুদ্ধ বর্ণান্ধ বলা যায়, কী বলেন?”  
“আপনার সেন্স অব হিউমার কিন্তু বেশ মশাই। এই বিপদের দিনেও...পারেনও বটে। তা কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধে হয় না আপনার, এই যেমন কোনটি কী?” 
“না, একদমই না সাদাকালো টিভিতে আপনার কোনও কিছু বুঝতে অসুবিধে হত কি? কিংবা সাদাকালো সিনেমায়? সেখানে তো চরিত্রেরা ‘দেখো তোমায় গোলাপ দিলেম প্রিয়ে’, ‘দেখো এই আদিগন্ত বনানী’ -সব হামেশাই বলে আমরা তো পরদায় সেই গোলাপ বা বনানীর কালো রং দেখি, কিন্তু কালো রঙে তো ওদের আর কল্পনা করি না, তাই না?”
“ঠিক বলেছেন। যুক্তিটা দারুণ!”
“হে হে, কী যে বলেন!”  
যাইহোক, একটা আই-ড্রপ দিচ্ছি, রাতে শোবার আগে চারফোঁটা লাগাবেন আগামী সপ্তাহের মধ্যে না-সারলে কোনও স্পেশালিস্টকে রেফার করব কিন্তু
“বেশ, তাই-ই করবেন। এক সপ্তাহ ট্রাই করি তবে।”
তাই করুন।”
“হু।”
তাহলে আর কী, শুভ সন্ধ্যা, কেমন! 
“একদম একদম। তো ফির কভি মিলেঙ্গে!”   
 বাব্বা, এন্ট্রি আর এক্‌জিট, সবটাই ফিল্মি! ক’টা ছারপোকায় কামড়েছে কে জানে বাপু!
              লোকটা চলে যেতেই ঘড়িতে চোখ রাখেন দিদিমণি সন্ধে সাড়ে ছয়। আটটায় চেম্বার সেরে উঠে যাবার কথা। বাইরে বেরিয়ে দেখেন, দোকান ফাঁকা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি তখনও। শ্যামদা একমনে বইয়ে মাথাগুঁজে বিড়বিড়িয়ে যাচ্ছেন:

একবার অন্তত
প্রেমিকাকে নিয়ে উড়ে যাও ছাদে...
                              আকাশ গর্ভবতী...


            এই মুহূর্তে শ্যামদাকে বিরক্ত করতে খারাপ লাগছে তাঁর। তবু কিছুক্ষণ পর বলেই ফেললেন, “দাদা, আর তো কেউ নেই মনে হচ্ছে, আজ তাহলে উঠি, কী বলুন!”
যেন বৃষ্টিঅরণ্য থেকে মুখ তুললেন শ্যামসুন্দর হাতে আড়বাঁশি। কবিতায় ডুবে ছিলেন এত সময়। ডুবেই তো ছিলেন, তাই ভাসতে একটু দেরি হল। ভাসতে-ভাসতে দেখেন আকাশ গর্ভবতী! অবশেষে ঘোর কাটিয়ে বলেন, “সাতজন তো ছিল। কিন্তু আর আসবে না বোধহয় কেউ যা বৃষ্টি! চলুন, আপনাকে পৌঁছেদি।
“আমি পারব যে। আপনি বরং পড়ুন।”
“না না। তাই হয় নাকি? আপনার কাছে ছাতাও নেই দেখছি এই ছোটকা, আমি আসছি একটু, দেখিস” পাশের দোকানীকে দায়িত্ব দিয়ে একটা হনুমানছাতার নীচে ম্যাডামকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন টোটো-স্ট্যান্ডের দিকে। দিদিমণিকে টোটোয় তুলে দিয়ে ফিরে এলেন ‘স্বপ্নচর চশমা’য়এসে আবার ডুবদোকানে এত এত চশমা, লোকে আসে, দেখে, কেনে, কিংবা কেনে না অনেকেই তো ফট করে বলে ফেলে:
দাদা, আপনার চোখে দেওয়া চশমাটা বিক্রি করা যাবে?”
“ওইটেই সেরা!”
“কত লাগবে বলুন না আগে!”
“ওটা কিন্তু আপনি লুকিয়ে রেখেছিলেন, খেয়াল করেছি!”
“নিজের জন্য বেছে রেখেছিলেন নাকি?”
“এটা কিন্তু ঠিক নয়!”
“আপনি স্বপ্নচোর!”
“আপনি স্বার্থপর!”
“আপনি...আপনি...আপনি একটা...” বলতে-বলতে কাঁপুনি লেগে যায় ওদের। ডুবে থাকা মানুষ কি আর শুনতে পায় বাতাস-মাধ্যমের এত এত হাহাকার? ফলে খদ্দের ফিরে যায়হাহাকারের অনুরণন বাজতে থাকে ঘরে, ঘর ছাড়িয়ে রেল-স্টেশানের চোঙায়, এমনকি রাস্তার মোড়ে-মোড়েমানুষজন মেয়ে-মডেলের হাতে-ধরা পুরুষের গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া বিশ্বাস করে, মাইক বিশ্বাস করে, দিনভোর চিৎকারের পুনরাবৃত্তি বিশ্বাস করে; বিশ্বাস করে না শুধু নারী ও নদীর অতল বক্ষদেশ আর এই বিপুল অরণ্যবৃষ্টি!   

শিল্পী:চন্দন মিশ্র




                                                       দুই
লোকটাকে ভুলেই গিয়েছিলেন দিদিমণি! ভেবেছিলেন আর আসবে না হয়তো। সাতদিন পার হয়েছে সাতদিন আগেই। এরকম স্ক্রু-ঢিলা কেউ যদি ভিড়ের সময় আসে, তবে সেদিনের মার গেঁড়ে গেল!
             আজ সন্ধে-জানলায় কোনও আলপনা নেই টিমটিমে তারামণ্ডল নেই উত্তম নেই, সুচিত্রা  নেই, রাইমা নেই, রাগরাগিণী নেই। সেই বিকেল চারটে থেকে টানা পেশেন্ট দেখা আছে শুধু। এখনও ঘন্টা দেড়েক থাকতে হবে ভেবে কষ্ট হচ্ছে খুব পেশেন্ট নেই বেশি আর। কিছু পরে ফাঁকা হয়ে এলে আলো নিভিয়ে স্লিপিং-চেয়ারে এলিয়ে পড়েছেন কিছুক্ষণ কানে-কানে চলবে উত্তম-সুচিত্রা।  
              এমন সময় দরজাটা ঈষৎ খুলে যায়। বাইরে থেকে আচমকা আলো এসে দিদিমণির মুখে পড়ে দরজার দিক থেকে দেখলে মনে হবে মুখটা সুচিত্রার মতোই! ম্যডাম আজ শাড়িতেও বেশ। 
             দরজার ফাঁকে সেই ঝাঁকরাচুলোকেই মনে হল দাঁড়িয়ে। হ্যাঁ সেই-ই তো। কী যেন কী নাম?...ওহো রবীন্দ্রনাথ!...আরে আরে ‘শ্রীরবীন্দ্র নাথ আর কী! কিন্তু আজ তাঁর চোখে চশমা নেই কেন? তাঁকে দেখেই হেডফোন সরিয়ে চেম্বারের আলোটা জ্বালেমুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ। চুল-পোশাক দেখে মনে হচ্ছে সমস্যা বেড়ে ছ’গুন। লোকটি উদ্‌বিগ্ন গলায় বলেন, “আসব ম্যডাম?”
আরে, আসুন আসুন!”   
“ডিস্টার্ব করলাম, বলুন?”
“না না। এটা তো আমার পেশা। বলুন, এতদিন কোথায় ছিলেন?”
“পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের সুচিত্রা সেন...” 
 পঙ্‌ক্তিটি শুনে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেনতাহলে এবারে কবিতার পোকাতেও কামড়েছে রবিবাবু-কে!     
“আপনার রঙের কথা বলুন। আই মিন, রঙহীনতা।”
রবিবাবুর মাথাটা নিচু। আরও বিষণ্ন। আরও এলোমেলো। চুলদাড়ি আর কাটেননি বোধহয়। কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর ফের পেপার-ওয়েটটা হাতে নিয়ে এক ঘুল্লি দিলেন। ওটা ঘুরতেই থাকল। পৃথিবী ঘুরছে। এবারে দিদিমণি নিজেই ওটাকে থামালেন। এখন দিদিমণির মুঠোয় পৃথিবীটা।  
“হ্যাঁ, বলুন!”
দিদিমণির কথায় যেন সম্বিৎ ফেরে রবীবাবুর। মুখ তুলে ধীরে-ধীরে বলেন:
“ম্যাডাম, পরশু বিকেলে হঠাৎ যেন মনে হল, এই রঙচঙহীন জীবন রেখে আর কী লাভ? তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, চলে যাব!”
“চলে যাবেন?” দিদিমণির কণ্ঠে চাপা উদ্‌বেগ!
“হ্যাঁ, যাব! আর যাবই যখন, তখন রাজার মতোই যাব। তাই নতুন একটা জামা পরে  রেলবাজার থেকে অমৃতদার ছোলাভাজা-আলুচপ আর বাদামখাজা কিনে চুয়াখালের উপরে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ। সেই ক্ষয়ে যাওয়া রেলিং-ধারে। চারিদিকে ধান আর ধান, আর তারই ভিতর এঁকে-বেঁকে চলে যাওয়া চুয়াখাল। কোনও একদিন নাকি সেটি নদী ছিল। নদী মরে খাল। খালও মরে যাবে একদিন। হারিয়ে যাবে ধানখেতের ভিতর। আর আমিও মরে যাব, হারিয়ে যাব। তাই কটকটিকে আড়ালে রেখে সেতুর উপর দাঁড়িয়ে। ও দেখতে পেলে খুব কষ্ট পাবে। আর ঠিক করি, ওই রেলিং থেকেই খালে ঝাঁপ দেব। এখন বর্ষা, এক-দেড়মানুষ জল তো হবেই। চারিদিকে কেউ নেই। সাঁতারও জানি না। জেলেরা ঘরে গেছে। এই নির্জন দুপুরেই কেল্লাফতে!”  
“কী ভয়ঙ্কর! তারপর?” 
“হঠাৎ চোখ বন্ধ করে দিলাম এক বাবরি লাফ! লাফ দিয়েই জলে। জলে হাবুডুবু খাচ্ছি। খাচ্ছি তো খাচ্ছি! নাক-মুখ দিয়ে জল ঢুকছে। জীবনের অতীত থেকে বর্তমানের টেলিকাস্ট শুরু হল ব্রেনের মনিটর-স্ক্রিনে দেখছি নিজেকেই পরপর ঘটনাবিহীন ঘটনায় দেখতে-দেখতে ইন্টারভালে পৌঁছে গেছি। কিন্তু ম্যাডাম, সেদিন বোধহয় ভগবানের ব্যাডলাক ছিল!”
“ব্যাড...লাক..?”
“কেন নয়? হঠাৎ মনে হল চুলের মুঠি ধরে কেউ আমাকে উপরে টেনে তুলছেকে রে তুই? আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কে তোকে অধিকার দিয়েছে টেনে তোলার? শেষে দেখি এক বৃদ্ধ মাঝিআমাকে ডাঙায় তুলেই পেছনে কষে লাথি! বলে, ‘হারামির পো, বউডারে বেধবা করবা? পুলাডারে অনাথ করবা?’ কে কার বউ রে বাবা! বিয়ে করলাম কই আর পুলাই-বা হল কবে? কটকটি শুনেছিল কি না কে জানে! শুনলে ওইখানেই হেসে খুন হত! মাঝখানে পেছনে ঢাকাই লাথিটা খেলাম মিছিমিছি। আমি তখনও বসে-বসে কেশে যাচ্ছি। কেলো বুড়োটা কী যে ক্ষতি করে দিল আমার...! তবু কিছু বলতে পারলাম না। কাশির দমক থামলে একটা বিঁড়ি চাইলাম। বৃদ্ধ দুটো দিলেন। শেষে বিড়ি টেনে আর অমৃতদার ছোলাভাজা আর বাদামখাজা চিবোতে-চিবোতে কটকটিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম 
“কী সাঙ্ঘাতিক আপনি!”
“সে না-হয় হল, কিন্তু আমার নতুন চশমাটা তো জলে গেল। পার্সে আপনার প্রেস্ক্রিপশানটাও ছিল, সেটা নেতিয়ে গেল, খসে গেল ফস-ফস করেএখন ছুটতে-ছুটতে আবার এলাম
“তা, আমার কাছে তো না-আসলেও হত, শ্যামদার কাছে বললেই ওই পাওয়ারে নতুন চশমা বানিয়ে দিতেন
“তা দিতেন উনিও সে-কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমি ভাবলাম, আপনাকে একবার দেখাই। ভাবলাম আপনি আজ আসবেন, আগে আসলে ভিড়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধা হতে পারে ফাঁকায়-ফাঁকায় হলে বেশ ভাল হয় আর কী
“তা এলেন কেন? রেফার করব কাউকে? মনে হচ্ছে একজন সাইক্রিয়াটিস্টকে দেখানো উচিত, অ্যাকিউট ডিপ্রেশন অ্যান্ড দেন অ্যাটেম্পট টু কমিট সুইউসাইড!”
“না না। রং নেই, তাই। রং অন তো ডিপ্রেশান গন!”
“তবু...”
“আসলে সেদিন যখন ডুবে যাচ্ছিলাম, ডুবতে-ডুবতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম জীবনের ষোলো রিলের রঙিন সিনেমা। উপরে উঠেও কিছুক্ষণ রঙিন রইল কিন্তু তারপর ধীরে-ধীরে সব আবার আগের মতো সাদাকালো!”  
“কী বলছেন?”
“হ্যাঁ, সেই জন্যেই তো ছুটে-আসা। আপনার ড্রপটায় কাজ দিচ্ছে মনে হল। আর আপইনাকেই চিকিৎসা করতে হবে এখন
“দেখুন রবীন্দ্রনাথবাবু...”
“শ্রীরবীন্দ্র নাথ...শুধু রবিও চলবে 
“আচ্ছা, বেশ। আপনাকে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভাল, আমি কিন্তু চিকিৎসক নই, আমি একজন অপ্টোমেট্রিস্ট, বাংলায় যাকে বলে দৃষ্টি-পরীক্ষক। আমি চোখ পরীক্ষা করে চশমার পাওয়ার দিয়ে থাকিকিন্তু চোখের চিকিৎসা করবেন চক্ষু-বিশেষজ্ঞ। সেজন্যে বলছি, রেফার করব কাউকে? একজন সাইক্রিয়াটিস্টও এক্ষেত্রে আপনাকে হেল্প করতে পারবেন
“বাহ্‌ বাহ্‌ কিয়া বাত! তাহলে তো আপনিই ভালো পারবেন ম্যাডাম। দেখুন আমাদের একটা সাদাকালো প্রটেবল টিভি ছিল পাড়ার লোকজনের সে কী উপচে-পড়া ভিড়, বিশেষ করে শনি-রবির সন্ধ্যায় সিনেমা তখন সেই দু-দিনই। শুক্রবার ছিল বি-টিভি আর বিপাশা হায়াত, দ্য হার্ট-থ্রব! তো বাবা একদি করলেন কী, সামনের নীল কাচ সরিয়ে সেখানে ট্রেনে-বাসে বিক্রি-হওয়া একটা রঙিন কাচ জুড়ে দিলেনব্যস। তারপর থেকে ছবিগুলো মাঝে-মাঝে রঙিন লাগত সাদাকালো টিভি জুড়ে ভাঙাচোরা রঙিন ছবি! তা এমন কিছু চোখের জন্য করা যায় কি?
“না, যায় না
রবিবাবুর চোখেমুখে হতাশাচিহ্ন স্পষ্ট
“তাহলে...কোনও উপায় নেই দেখছি 
“না, নেই। আমার কাছে তো নেই-ই। আচ্ছা, জায়গাটার নাম কী বললেন যেন?” 
“কোন জায়গা?”
 “যেখানে খালটা
“ও...ওটা চুয়াখাল। যাবেন নাকি একদিন বিকেলে? ভারি চমৎকার জায়গা। এখান থেকে টোটো করে মাত্র আধঘন্টা। বলবেন ডুমো-চুয়াখাল যাব। পনেরো টাকা। একবার গেলে মাথা থেকে সুইজারল্যান্ড-ওয়েসেক্স সব ভ্যানিশ হয়ে যাবে ম্যাডাম
“আচ্ছা যাব। কাল সময় হবে আপনার?
“কাল?”
“হ্যাঁ, কাল বিকেল, মানে এই ধরুন বিকেল চারটে?” 
“হবে মানে, আলবাৎ হবে। দরকার হলে কাল ছুটি নেব!” 
“উঁহু, ছুটি নিতে হবে না। তাহলে ছুটির দিনেই হোক
“না না, কাল তো কালই!”
“আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, আপনি জলে ডুব দিলেন, আর তারপর উঠে দেখলেন সব কিছু রঙিন হয়ে গেল?” 
“হ্যাঁ, হল তবে ক্ষণিকের জন্য
“আমি নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখতে চাই, সে-জন্যেই যেতে-চাওয়া আসলে
“তাহলে তো আমাকে আবার ঝাঁপ দিতে হবে!”
“হ্যাঁ, দেবেন আপনি তো তাই-ই চান, তাই না?”
“তা চাই, কিন্তু আপনিও কি তাই চান? একজনের মৃত্যু?”
“ও মা, বাঁচানোর জন্য মাঝি বেচারাকে কত গাল পাড়লেন আপনি, মনে নেই?”  
“বেশ। তবে আমি যে কিছু সময় ধরে রঙিন পৃথিবী দেখব, বা দেখব না, তা কে বলবে আপনাকে?” 
“আপনার বডি তুলে চোখ পরীক্ষা করে জেনে নিতে পারব চিন্তা নেই।”
“কী নিষ্ঠুর! আপনি সুচিত্রা সেন না চিটফান্ড সেন সেইটা আগে বলুন তো ঠিক করে?”  
“তাই নাকি? তবে আমার খুব সুচিত্রা হবার ইচ্ছে হচ্ছে এখন।
“পারবেনই না। আলবাৎ না!”  
“হাঃ হাঃ! বেশ বেশ। আপনাকে ঝাঁপ দিতে হবে না। কিছুই করতে হবে না। ভয় নেই। শুধু আসবেন। এইটুকু। তাহলে কাল দেখা হচ্ছে। পাক্কা?”
“পাক্কা!” 



                                     তিন

এখানে অজস্র ঘুড়িমেঘ উড়ছে আকাশে। লাটাই হাতে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে ওই দূরে কোথাও। অজস্র জলফড়িং ঘাসে-ঘাসেদস্যিমেয়েটা আজও চুল ছেড়ে আকাশেপাখপাখালির ঝাঁক ছবি আঁকছে নৈসর্গিক ক্যালাইডোস্কোপে। ওদের কিচিরমিচির মাটিতে এসে পুনরায় ফিরে যায় আকাশে রবিবাবু বিপুল আলখেল্লায় আকাশপথে মগ্ন হাতে অস্থির তুলি। ধানখেতের মধ্যদিয়ে চুয়াখাল এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহুদূর, শেষে মিশে গেছে ইছামতীর সঙ্গে। খালে কত ভেচাল, ভেচালে মাচা, মাচায় বসে-বসে জেলেরা জাল নামায়, জাল তোলে দিবারাত্রিজালে শিলাবৃষ্টির মতো বিপুল মাছ পড়ে জালে মাছ লাফায়। লাফায় জেলেরাও। পাড়ে দাঁড়িয়ে খালে খ্যাপলাজাল ছুঁড়ে মারছে কেউ কেউ। জাল টানার পর কচিকাঁচাদের সে কী উল্লাস! বাড়ির মেয়ে-বউয়েরাও চলে এসেছে পুরুষদের সাহায্য করতেছোট-ছোট নৌকো, তালডোঙা পাড়ে বাঁধা, মাছধরার জন্যই।
             জায়গাটা সত্যিই দারুণ। চারিদিকে বৃষ্টিভেজা তালখেজুরের শোভা। নববধূর মতো যৌবন ছড়িয়ে পড়েছে গাছে-গাছে ঘাসে-ঘাসে। লোকটা ভুল বলেনি কিছুইখাল এখন জলে টইটম্বুর আজ সকালেও তুমুল বৃষ্টি হয়েছে। মেঘ করেছে ফের, বৃষ্টি নামবেই।
             এটাই তো সেই সেতু! এই তো কংক্রিট ক্ষয়ে-যাওয়া রেলিং! কথামতো ঠিক সময়ে এসে দাঁড়িয়ে আছেন দিদিমণি, কিন্তু রবিবাবুখনও এলেন না যে! লোকটা কি তবে ভুলে গেল সবকিছু? ভুলতেই পারেন, যা গ্যাদড়া লোক মাইরি!
             টোটোয় এসেছিলেন একাই নেমে টোটোকে ছেড়ে দেন ...কতক্ষণ অপেক্ষা আর? ফোন করলেও লাগে না। টুরুত-টুরুত...বিপবিপ ফুঁস! ...এখানে টাওয়ার-পাওয়াও মুশকিল।
             ... নাহ্‌, আর আশা নেই ...ঘন্টা পার হল যে! পাগল-ছাগল মানুষের পাল্লায় পড়লে আর যা হয়। ...দিদিমণি স্থির করলেন, ফিরে যাবেন ...এক-দু’পা হাঁটাও শুরু করে দিয়েছেন তিনি কতদূর হাঁটতে হবে কে জানে! পথ তো অনেকটাই। তারপর কিছু পাওয়া যাবে তো আদৌ? 
               হঠাৎ দেখলেন, দূরে একটা ধলতা স্কুটার ঠেলতে-ঠেলতে এদিকেই এগিয়ে আসছে কেউদূর থেকেই হাত তুলে চিৎকার, “ম্যাডাম ম্যাডাম...”
               আরিব্বাস, সাদাকালো পরদায় রবিবাবুর এন্ট্রি হল যে! হাঁপাতে-হাঁপাতে প্রবেশ, প্রকৃতির প্রবেশদ্বারে 
“দেরি হয়ে গেল ম্যাডাম ভীষণ ভীষণ দুঃখিত। ফোনের এখানে যা-তা অবস্থা বুঝলেন! আপনাকে খামোখা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল আসলে একশো চার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে খুব অবস্থা খারাপ। কাল ভিজে ভিজে এমন, জানেন!”
“সে কী, আপনার একশো চার জ্বর আর আপনি এখানে?” 
“না না, আমার না আমার না, কটকটির। আপনি যাকে মনে-মনে ধলতা বললেন এই মাত্রকাল বৃষ্টিতে ভিজেই তো ওর ধুম জ্বর। ও-বেটির ভিজলেই এমন হয় স্টার্ট নেয় না কিছুতেইআসছিলাম, তা পথের মাঝখানেই ব্যাগড়া দিতে শুরু করল। প্রথমে যাও-বা এক-দুবার স্টার্ট নিল, পরে তো নিলই না আর। অগত্যা
“তা আমি যে মনে-মনে ধলতা বললাম, আপনি শুনতে পেলেন?”
“হাঃ হাঃ! ছাড়ুন ছাড়ুন! জলে ঝাঁপ দেব কি না সেইটে আগে একবার বলুন!” 
“আরে না না, জলে ঝাঁপ দিতে হবে না। আপনার অকালমৃত্যু হোক চাই না
“রঙহীন জীবনের অর্থ আপনি কী করে বুঝবেন ম্যাডাম? শুধু জীবনটাই আছে, তাকে রোজ টেনে-টেনে ঘ্যাঁসটাতে-ঘ্যাঁসটাতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শুধু!”            
“ঠিক বলেছেন। এইবার আরও ঠিক করে বলুন, এই সেই জায়গাটা তো যেখান থেকে আপনি ঝাঁপ দিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ, ঠিক তাইনিন, আগে ভোলাদার ছোলাভাজা-বাদামখাজা খান। এ-চত্বরে এমনটি আর পাবেন না। ছোলা সেদ্ধ করে তেলে ভেজে পেঁয়াজ-রসুন কুঁচিয়ে বানানো স্পেশাল রেসিপি। নিন, ধরুন আর ঝাল লাগলেই খাজা!
“বাহ্‌, সত্যিই দারুণ তো খেতে! আচ্ছা, নিন, ধরুন, এসে খাচ্ছি বাকিটা, খেয়ে ফেলবেন না কিন্তু! আর আমার এই চশমা আর ব্যাগটাও কাছে রাখুন 
             সেতুর পাশ দিয়ে নেমে-যাওয়া সিঁড়ি দিয়ে ম্যাডাম ধীরে-ধীরে নেমে গেলেন আলতাপা-ডুবজলে। রবিবাবু সেতুর উপরে রেলিং ধরে দু-হাতের উপর ঝুঁকেচুলে তাঁর বিকেলের পড়ন্ত মেঘলা আলো। উপরে পাখিদের ঝাঁকে-ঝাঁকে আকাশ-উড়ান হয়তো এইসব পাখিরা উড়তে-উড়তে ঝাঁকড়া চুলের ছায়ায়-মায়ায় হারিয়ে যাবে একদিন।
              দিদিমণি খালে নেমে দু-হাতের তালুতে জল তুলে চোখে ঝাপ্টা দিতে থাকেন কয়েকবার। আজও শাড়ি পরেশাড়ির ভাঁজে-ভাঁজে বনলতা, লতার ফাঁকে-ফাঁকে সেতার-সানাই আঁকা, তাতেই বুঝি মিঞামল্লার! শাড়িতে মেঘচুল, চুলে কাশফুল, ফুলে কু-ঝিকঝিক সাবেকি ট্রেনের চলে-যাওয়া। আকাশের সাদাকালো পরদায় মিশে যাচ্ছে কালো-কালো ধোঁয়া। “চুল তার কবেকার...” মুগ্ধবোধে রবিবাবু যেন ক্ষণিকের জীবনানন্দ!   
              শাড়িতে সুচিত্রা সেন?
              শাড়ির কিছুটা ভিজে গেল জলে দিদিমণি এবারে মুখ তুলে চাইলেন সেতুর ’পরে, দেখলেন, সেতু থেকে তাঁর দিকে চেয়ে আছে এক উত্তম পুরুষ, পেছনে আলো-মেঘের বোঝা মাথায় নিয়ে হেলে-পড়া সূর্য।
              ধীরে-ধীরে সিঁড়ি বেয়ে সেতুর উপরে উঠে আসেন দিদিমণি
“আপনাকে না পুরো সুচিত্রা লাগছে!” 
“আর আপনাকে অতি উত্তম...”
দুজনেই একসঙ্গে খুব হাসল। খুব...খুউউউব! পাখিগুলোও হাসল বুঝি, একসঙ্গে, ঝাঁকে-ঝাঁকে মেঘগুলোও কি হাসল তবে?
“আসলে রবিবাবু, আমিও রঙহারা বহুদিন কাউকে বলার সাহস পাইনি, আপনি যেমনটি পেরেছেন চুয়াখালের জলে চোখ ভিজিয়ে দেখলাম, বেশ রাঙা লাগছে পুরোনো পৃথিবীকে পৃথিবীর সকল রঙ যেন নতুন করে ওই পেপার-ওয়েটটার মতোই আমার চারিদিকে প্রদক্ষিণ করছে বনবন করে। নতুন লাগছে সবকিছুবোধহয় প্রকৃতির সব ধুয়ে এখানেই জমা হয়েছেকীভাবে কখন যে জীবন থেকে, যাপন থেকে, চোখ থেকে, মন থেকে এক-একটি রং হারিয়ে যায় আমাদের, আমরা তা বুঝতেই পারি না!”   
“ঠিক তাই 
            সারাদিন হারাধন মণ্ডলের মতো মাথায় টোকা পরে দেবাদিদেব মহাদেব লাঙল নিয়ে আকাশটা চষে বেরিয়েছেন। এখন মই দিচ্ছেন শুধুমেঘগুলো মই-দেওয়া মাখনমাটি যেনউপরে থৈ-থৈ জল। এবারে সেই জল গড়িয়ে পড়বে নীচে বুঝি-বা! পাখিদের পিছু-পিছু এসে পড়বে তাল-খেজুর-শিরীষ-আমের উপর। দস্যি মেয়েটাও মায়ের তাড়া খেয়ে চুল থেকে জল ঝেড়ে ফেলবে গামছা দিয়ে।
            খাঁ-সাহেব সন্তুর নিয়ে বসে পড়লেন আবার, সঙ্গতে জাকির হুসেন। সেতার-সানাই? কারা?
            শ্যামদা পুনরায় ডুবে গেলেন অতলে:
প্ররোচনা ঘিরে বাকি রাত শুধু ওড়া!
প্রতি চুম্বনে বেরিয়ে আসুক
            অগ্নিমুখর ঘোড়া...

             তার ব্যক্তিগত চশমা খুলে রাখা পাশে। খদ্দের এসে দেখছে, পরছে, খুলছে, শেষে ঘোড়ার মতো ছুটতে-ছুটতে চলে যাচ্ছে গহিন অরণ্যে। অরণ্যে বৃষ্টি নামছে আবার। আবার বুঝি ডুবে যাবার পালা!          
“ম্যডাম, বৃষ্টি নামছে খুব, চলুন তার আগে বেরিয়ে পড়ি।”  বলতে-বলতেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু। দুজনে দেখল, আকাশ থেকে রঙিন জলশরীর নেমে আসছে এক-এক করে, আর তা মাটিতে পড়া-মাত্রই রং ফিরে পাচ্ছে গাছপালা-মাঠঘাট-পশুপাখি-ঘড়বাড়ি-ঝোপঝাড় বিস্তীর্ণ সাদাকালো ধানখেত এখন সবুজে-সবুজ। রবিবাবু রঙতুলি নিয়ে ফের মেতে ওঠেন আকাশে। রং ফিরে পেয়ে দু-হাত আকাশে মেলে ধরে প্রজাপতির মতো, যেন ইউরেকা, যেন লর্ডসের গ্যালারিতে দাদা! 
             বাতাসে আবার তুখোর মিঞামল্লার
             তবু এই পথ ও তাঁরা দুজন এখনও সাদাকালোবৃষ্টিতে আবার যদি কটকটির একশো চার হয়? কিন্তু কী আশ্চর্য, কিক্‌ মারতেই স্টার্ট!  
“ম্যাডাম, একবার কটকটিতে আসবেন?” 
“আমিও ভাবছিলাম জিজ্ঞাসা করি
“তাহলে আসুন না!” 
            সেই পথে বেয়ে ক্রমশ এগিয়ে যায় ওঁরা তালখেজুরে ঘেরা একটা সুদীর্ঘ আঁকাবাঁকা পথ আরও কিছুটা দীর্ঘ হল আজ ওঁদের ফেলে যাওয়া পথটাও রঙিন হয়ে ওঠে ধীরে-ধীরে। রঙিন হয় ওঁরাও, রাইমা ও উত্তমে। শুধু কটকটি যেন এক অগ্নিমুখর ঘোড়া!   
            পৃথবীর সকল অরণ্য-ঘোড়াগুলোর এবারে আকাশে ওড়ার পালা।  


ঋণ:  বিভাস রায়চৌধুরীর কবিতা ‘ঘোড়া’।  
                        
      
 
শিল্পী: চন্দন মিশ্র 


No comments:

Post a Comment

।। কবিতা আশ্রম ব্লগজিন ।। তৃতীয় সংখ্যা ।। ডিসেম্বর ২০১৮ ।।

শিল্পী: চন্দন মিশ্র                                                           কথা    ফের নকশিকাঁথার ভাঁজ খুলে মাঠে-মাঠে অঘ...