Wednesday 31 October 2018

।। রাখা হয়েছে মেঘ যখন যেমন চাই ( প্রসঙ্গ: কবি নিত্য মালাকার) ।। রিমি দে ।।

রাখা হয়েছে মেঘ যখন যেমন চাই           
রিমি দে



মনে হয় সত্যমিথ্যের যমজ-জন্মের আগে গান ছিল–––আমার এক প্রিয় কবির (উৎপলকুমার বসু) উচ্চারণের সূত্র ধরে বলি, ওই মনে হওয়া গুনগুন থেকেই তুলে নেওয়া যায় হাসি ও হাহাকার। এমন একটি ফুলের দিনের জন্য কবিতা লেখা, যে-দিনে ফুল ও কবিতা বৃষ্টি হয়ে ঝরতে-ঝরতে বয়ে যায় নিজের ধারায়। সে-ধারাপাতে কবির মোহ মোহন ও অর্জন এমন এক সংকেত বহন করে যেখানে কবি নিঃস্ব হয়ে যেতে চায়, আবার এক আশ্চর্য অপূর্ব যা শুধু বাঁশির নীরব সুরে অন্তরের অন্দরে কানায় কানায় ভরিয়ে দেয়।   
               একজন প্রকৃত কবির ধারা কোন খাতে বইবে তা অজানা। তবে ভিতরঘরের পাগলগুলো যখন আগল খুলে দেয়, তখন কবির রোগ ও রোগমুক্তির কারণ কবিতাকেই নির্দেশ করে। কবি নিরুদ্দেশ হন কবিতায়। এমন এক নিরুদ্দেশের কবি নিত্য মালাকার। ভারত স্বাধীন হবার দু’দিন পরেই ওঁর জন্ম। অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের ১৮-ই আগস্ট। জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে। ১৯৫৬ সাল থেকে নবদ্বীপবাসী। তারপর কোচবিহার জেলার মাথাভাঙ্গায় চাকরিসূত্রে এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন। বাহান্ন বছর ধরে কবিতার সঙ্গে নিত্য মালাকারের ঘর করা। এ-কোনো সহজ কথা নয়। উনিশ-কুড়ি বছর থেকেই কবিতা তাঁর মন চুরি করে। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় কবিতায় ডুবে থাকা। নবদ্বীপে থাকাকালীনই একটু-একটু করে কবিতার কাছে চলে আসেন নিজেরই অজান্তে। পরিনত বয়সে নদী মানসাইয়ের পাশে বসবাস করতে-করতে ভিতরেও এক মানসাই লালন করতেন। তাইতো নির্জনতাই নিত্য মালাকারের পরমপ্রিয় হয়ে ওঠে।
               নিত্য মালাকারের কবিতা মানেই এক নিভৃত পথিকের নিরুচ্চার কণ্ঠ। স্বগতোক্তির মতো সত্যভাষ। যেন এক অনন্ত ব্রহ্মনাম। সময়কে সঙ্গী করে ভাবে-বৈভবে-দর্শনে চরম বিন্দু ছুঁয়ে থাকার প্রবনতা। লৌকিককে কবিতার অলৌকিকে পৌঁছে দেবার যাদুটোনায় নিত্য মালাকার সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বাংলা আকাদেমি থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। পেয়েছিলেন ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি বিভা চট্টোপাধ্যায় স্মারক সম্মান’। তবু প্রান্তে বসবাস করার জন্য সেই প্রচারের আলো তেমনভাবে ওঁর কবিতায় পড়েনি। প্রকৃত কবি কি আর প্রচার চান? কবি চান নির্ভেজাল কবিতাযাপন। কবি চান সত্যের খুব কাছে থেকে জীবনদর্শন। আর দর্শনের গভীর থেকে উঠে আসবে সেইসব আশ্চর্যময় কুয়াশাঢাকা কবিতা। যে কবিতা স্বল্প ছুঁয়ে ফেললে আরো নিবিড় করে পাবার ইচ্ছে জাগে। অথচ তার রহস্যময়তাকে কখনওই ভেদ করা যায় না। কবি নিত্যর কবিতার কী এক অমোঘ আকর্ষণ যা নিয়ত তাড়া করে নিবিড় পাঠককে! নিত্য মালাকার স্বমহিমায় মফস্বলের ঝিঁঝিডাক আর জলফড়িঙের মধ্য থেকে মুক্তোর যাপনটুকু আলগোছে কুড়িয়ে ভাষার দ্যোতনায় উপলব্ধিকে বেঁধে ফেলেন পঙক্তিতে। অনুভবের গভীরতায় রচিত হয় নিবিড় উচ্চারণ:    
        ইদানিং বৃষ্টির দিনে কিছুটা এগিয়ে হেঁটে পেয়েছি ব্রহ্মস্বাদ
                               এবং প্রতিভাময়ীর ওই অতুল উষ্ণতা
        পেয়েছি পাখির ডাক দোয়েল ও শিমুলের চৈত্র-রটনা
        উত্তরোত্তর পর্যায়ক্রমে দেখেছি বিরহ-খাদ
                                            দেখেছি সমুহ
        এবং তা সতত গোলাপি আর ঘাসের জঙলে উদগ্রীব
        হেসেছি প্রভাত ছুঁয়ে সন্ধ্যা-রাত্রি ছুঁয়ে ওই অভিমুখে
                                    নত, প্রণত হতে-হতে
        কেঁদেছি, বলেছি কথা বিন্দু-বিন্দু থেকে বারিকণা থেকে

                ‘আমাদের ঘোড়া’  কবিতায় তিনি বলেন:

আহ, কী সবুজ-বলে
আর্তনাদ করে উঠল আমাদের ঘোড়া

আহ, কী অগাধ বলে
ভেঙে কুটিপাটি হল আমাদের ঘোড়া

মনে পড়ে, কখনো এমন কথা
তোমাকে বলেছি?

বলেছি, বলেছি

                 বাস্তবের অনুষঙ্গই উঠে আসে কবি নিত্যর নিত্যদিনের কবিতার আনাচকানাচ। অথচ অসাধারণ দক্ষতায় তা আবহমানের ইঙ্গিতের বাহক। ‘মাধব’, ‘যাদব’, ‘গোঁসাই’, ‘ব্রহ্ম’-----এই শব্দগুলি ওঁর কবিতায় ঘুরেফিরে আসে। গৃহী হয়েও এক বাউলমন ওঁকে তাড়িয়ে বেড়াত খুব।  
                হৃদয়ের গহীন থেকে দেখানো এই সহজ জীবনের সহজিয়া রূপের আড়ালে দীক্ষার যে গভীর মর্মার্থ উঁকি দেয় সেখানেই নিত্য মালাকার ওঁর নিজস্ব ভাষাবোধ ও উপলব্ধিতে অনন্য, অগাধ ও চিরকালীন। প্রচুর কবিতার পঙক্তি বুকে ধরে রাখার মতো। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি! ওঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল ‘অন্ধের বাগান’, ‘সূত্রধরের স্বগতোক্তি’, ‘দানাফসলের দেশে’, ‘গীতবিতানপ্রসূতরাত্রি’, ‘এই বৃষ্টিধারা’, ‘যথার্থ বাক্যটি রচনার স্বার্থে’ ও ‘নিমব্রহ্ম সরস্বতী’। ‘মাথার ভেতরে নক্ষত্রখচিত রাত্রি’ নিয়ে নিত্য মালাকার ছটফট করেন কবিতার জন্য। বলেন:
বুঝি, ভুলিয়ে-ভালিয়ে আনা হয়েছে এখানে
যতই পাথর হোক, অমসৃণ, কঠোর বা নির্জন—
দেখছি অর্কিড-নরম আর নিচে, মহা নিচে স্বচ্ছন্দ জল
 নিজেই নিজের বুক ঢাকছে ফেনায়...

শিল্পী: চন্দন মিশ্র 

No comments:

Post a Comment

।। কবিতা আশ্রম ব্লগজিন ।। তৃতীয় সংখ্যা ।। ডিসেম্বর ২০১৮ ।।

শিল্পী: চন্দন মিশ্র                                                           কথা    ফের নকশিকাঁথার ভাঁজ খুলে মাঠে-মাঠে অঘ...