Friday 3 August 2018

।। কবিতা আশ্রম ।। ব্লগজিন ।। আগস্ট ২০১৮ ।।

                               ।। কথা ।। 

কবিতা আশ্রম ছাপাঅক্ষরে প্রকাশ হয় প্রতিমাসে। তবু আবার ব্লগজিন কেন? ওয়েব-ম্যাগাজিন না প্রিন্টেট ম্যাগাজিন---–কোনটার মূল্য বেশি? কোন মাধ্যমটিকে পাঠক পছন্দ করেন? ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে সাহিত্য প্রকাশের মাধ্যম? আমাদের বিশ্বাস সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুটো মাধ্যমেরই পাঠক থাকবে। তাছাড়া দূরত্বের কারণে যেসব জায়গায় ছাপা পত্রিকা পাঠানো অসম্ভব হয়, সেখানকার পাঠক ওয়েব-ভার্সন পড়তে পারবে। সে-জন্যই কবিতা আশ্রম পত্রিকার নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রতিমাসের সফ্টকপি আপলোড করা হয়। আশ্চর্যের সঙ্গে দেখি প্রতি মাসেই ডাউনলোড সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে দুটো মাধ্যমকেই মান্যতা দিতে হবে। বনেদিয়ানার সঙ্গে চলুক-না আধুনিকতা! ক্ষতি কী! কবিতা আশ্রম-এর জুন সংখ্যা থেকেই শুরু হয়েছে গ্রন্থসমালোচনার নতুন বিভাগ ‘বই উৎসব’। নিভৃতে থাকা অপ্রচারিত বলিষ্ঠ কবিদেরই প্রাধান্য দিয়ে থাকে কবিতা আশ্রম। গ্রন্থসমালোচনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না। ব্লগজিনের উদ্দেশ্য আরও বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছোনো। আর প্রিন্ট আকারে পত্রিকা প্রকাশের বিপুল খরচের জন্য আমাদের সামর্থ্যও সীমিত হয়ে যায়। সেখানে আরও বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা যায় ব্লগজিনে। কত বই! কত ধরনের লেখক! কবিতা প্রকাশ ছাড়াও অনেক দায় আছে যে! শ্রেষ্ঠ নয়,সমগ্রের খোঁজে---কবিতা আশ্রম!


এই সংখ্যায় যাঁদের কাব্যগ্রন্থ আলোচিত হয়েছে— 
মারুত কাশ্যপ, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, রণদেব দাশগুপ্ত, গৌরব চক্রবর্তী, প্রমিতা ভৌমিক, অঙ্কুর মজুমদার, সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিমন্যু মাহাত, রফিক উল ইসলাম, আদিত্য মুখোপাধ্যায়
শিরোনাম: আমাকে মুছে দাও, অবহেলায়...
আলোচক: পাঠক সেনগুপ্ত
লেখাটি কবিতা আশ্রম-এর জুন ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত।
ব্লগজিনে সংযোজন: আলোচিত কাব্যগ্রন্থের কবিদের ছোট্ট সাক্ষাৎকার। যদিও আদিত্য মুখোপাধ্যায় ও অভিমন্যু মাহাত-র সাক্ষাৎকার আমরা পাইনি। রফিক উল ইসলাম হাতে লিখে উত্তর দিয়েছেন। তাঁর শৈল্পিক হাতের লেখায় মুগ্ধ হয়ে আমরা সেটাই রেখে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।  




অলংকরণ: মণিশঙ্কর 

।। কিছু শব্দ সাজিয়ে সমসময় আর অতীত-ভবিষ্যতের মাঝে একটা সেতু রচনার চেষ্টা করি: রণদেব দাশগুপ্ত ।।



রণদেব দাশগুপ্ত 



আলাপন

কবিতা আশ্রম: আপনার কবিতা-যাপন কতদিনের?
রণদেব দাশগুপ্ত: আমি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছি গত সাঁইত্রিশ বছর।

কবিতা আশ্রম: কবিতা লিখতে আসা কেন?
রণদেব দাশগুপ্ত: আমার কাছে কবিতা একটি মাধ্যম মানুষের কাছে পৌঁছোনোর। নিজের কিছু ভাবনা  বার্তা পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেওয়া  তাকে কিছুটা ভাবানো----এভাবেই আমার কবিতাকে আমি দেখি 

কবিতা আশ্রম: এই বইটি সম্বন্ধে কিছু কথা পাঠকদের উদ্দেশে বলুন।
রণদেব দাশগুপ্ত: ‘অন্ধকারের গম্বুজ’ আমার ষষ্ঠ কবিতাবই।  বইয়ে আমি অনুচ্চকিত স্বরে পাঠকদের হাত ধরতে চেয়েছি। কিছু একান্ত অনুভব, কিছু গাঢ় সময়ের কথা আমি ভাগ করে নিতে চেয়েছি পাঠকদের সঙ্গে।

কবিতা আশ্রম: আবহমান বাংলা কবিতায় আপনার বইটি নতুন কী দেবে?
রণদেব দাশগুপ্ত: আবহমান বাংলা কবিতা অনেক বড় একটা ব্যাপার। আমি আমার মতো করে কিছু শব্দ সাজিয়ে সমসময় আর অতীত-ভবিষ্যতের মাঝে একটা সেতু রচনার চেষ্টা করি। আবহমান বাংলা কবিতাকে আমার এই প্রয়াস কিছু দেবে কি না সে তো পাঠকেরা বলবেন। সময় আমার কবিতাকে ধরে রাখবে কি না তার উত্তর তো আগামীর গর্ভে।



অসময় প্রকাশনী, অশোকনগর, ৮০ টাকা






বই উৎসব

আমাদের চারপাশে গুপ্তহত্যার মতো নীল আলো জ্বলে। ‘মাঝে মাঝে একটা খোলসের ভিতরে/ ঢুকে যেতে বেশ লাগে।’ আমাদের চোখের সামনে ‘কুয়োতলা জুড়ে জেগে উঠছে স্মার্ট সিটি হাতে থাকছে শ্মশান বানানো’। কিন্তু তাতে কবির কী? তিনি তো কবিতা লিখতে জানেন। রণদেব দাশগুপ্ত’র ‘অন্ধকারের গম্বুজ’ (অসময় প্রকাশনী, অশোকনগর, ৮০ টাকা) অবশ্য সেই উদাসীন কবিতা-আশ্রয়ী জীবনের ছবি আঁকে না। ‘এমন সহজ ছন্দে নয়, তোমাকে তো আরও বেশি/ কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে।’ কবির বিশ্বাস, ‘যা কিছু লিখেছি আজ/সবই জানি মুদ্রণপ্রমাদ।’ কবিতাকে তাই কবি নীরব করে দিতে চান। এই অসময়ে কেবল ভাবেন, ‘সমস্ত শরীরে কি বুঝতে পারব কবিতার ঢেউ?’ আর সংশয়ের এমন প্রহরে কেবল মানুষের জন্য রণদেব চেয়েছেন, ‘এই জন্ম কাঁটাহীন হোক।
----‘আমাকে মুছে দাও, অবহেলায়...’/ পাঠক সেনগুপ্ত / কবিতা আশ্রম (মুদ্রিত)/ জুন ২০১৮


অলংকরণ:মণিশঙ্কর




।।কবিতার পাঠক হবার যোগ্যতা অর্জনের জন্যও আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করি: মারুত কাশ্যপ ।।



মারুত কাশ্যপ 



আলাপন



কবিতা আশ্রম: আপনার কবিতা-যাপন কতদিনের?
মারুত কাশ্যপ: কিশোর বয়স থেকে৷ প্রায় ২০-২৫ বছর৷

কবিতা আশ্রম: কবিতা লিখতে আসা কেন?
মারুত কাশ্যপ: কবিতার প্রতি ভালোবাসা থেকেই কবিতার ভাষায়, আঙ্গিকে  ভাবনা আসে৷ আর সেটা লিখে রাখি কারণ আমার নিজস্ব ভাবনাগুলো যেন না হারিয়ে যায়৷ কেউ না কেউ একদিন লেখাগুলো যত্ন করে পড়বে, এই অদ্ভুত আশা থেকেও লিখে রাখি সেটাও বলা যেতে পারে৷ আসলে কবিতার মধ্যে যে রহস্য, মায়াময়তা, অবর্ণনীয় অনুভূতির বুনন থাকে তারা যেন আমাকে কুহকের মতো ডাকে৷ সেই ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই৷ তাই বারবার কবিতার কাছেই আমার ফিরে আসা ও সমর্পণ৷ তাছাড়া কবিতার পাঠক হবার যোগ্যতা অর্জনের জন্যও আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করি৷

কবিতা আশ্রম: এই বইটি সম্বন্ধে কিছু কথা পাঠকদের উদ্দেশে বলুন।
মারুত কাশ্যপ: এই বইটি সম্পর্কে পাঠকরাই ভালো বলতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস৷ শুধু এটুকু বলার---গ্রামজীবন, যাপন ও গ্রাম সম্পর্কীয় নানা অনুভূতি যা প্রায় কুড়ি বছর ধরে আমি কবিতা বা কথকতার আঙ্গিকে লিখেছি, সেসব এই বইটিতে আছে এবং দীর্ঘ এগারো বছর পর আমার এই বইটি প্রকাশ পেল৷ মাঝে অবশ্য দু-একটা পুস্তিকা প্রকাশ পেয়েছিল বন্ধুদের ইচ্ছেতে৷

কবিতা আশ্রম: আবহমান বাংলা কবিতায় আপনার বইটি নতুন কী দেবে?
মারুত কাশ্যপ: সেটা আমি কী করে বলি? একমাত্র সময়ই পারে সে-কথা বলতে৷






কলিকাতা লেটার প্রেস, কলকাতা, ১০০ টাকা




বই উৎসব

ধরো, সে গ্রামের নাম মধুলক্ষ্মীপুর। গায়ে পড়া ঢলানি নদী/ গেঁয়ো সভ্যতার বাড়ি, গাছ, নরনারীগণ...’ সেই মনের মতো ছবি আর মনের মতো একটা নদীর কথা নিয়ে বেহুলা-ভাসানের সুরে এক স্বপ্নালু ‘গ্রামদেশ কথা’ (কলিকাতা লেটার প্রেস, কলকাতা, ১০০ টাকা) গেয়ে চলেছেন মারুত কাশ্যপ। তাঁর এই কৃষিকথা, চাল-ডাল, নদী-নালা, ভিজে আচলের স্নিগ্ধ নারীমনের ছোঁয়া আমাদের এই বাতানুকূল জীবনকে হঠাৎ শীতপ্রার্থী করে তুলল। তাঁর গ্রামদেশ কথা জুড়ে কী নরম রোদ্দুর, মৃদু লন্ঠনের আলো, ঘরে ঘরে ধনধান্য হয়ে ফুটে ওঠে হাসি, মেঠোপথে কত কাশ ফুটে থাকে, ঘাসফুল, শিউলি ফুলের গন্ধে মাতাল হয় আন-বাড়ি... এমন অজানা হৃদয়পুর কোথায় আছে যার প্রান্তরে আজও ক্ষীণ জ্যোৎস্না লেগে থাকে? তাঁর সেই গ্রামের মাটি অসহায়ভাবে আজও শহরকে চেনে। চেনে কোন গলির অন্ধকারে বিড়ি মুখে কুঞ্জবিহারী অপেক্ষায় আছে...সেই বদলে যাওয়া গ্রামদেশের ‘পদাবলী। রিমেক। লিখছে মারুত কাশ্যপ।’
--‘আমাকে মুছে দাও, অবহেলায়...’/ পাঠক সেনগুপ্ত / কবিতা আশ্রম (মুদ্রিত)/ জুন ২০১৮


অলংকরণ:মণিশঙ্কর


।। কাব্যগ্রন্থটি আশা করছি ঔষধের মতো কাজ করবে: অঙ্কুর মজুমদার ।।



অঙ্কুর মজুমদার 



আলাপন

কবিতা আশ্রম: আপনার কবিতা-যাপন কতদিনের?
অঙ্কুর মজুমদার: প্রায় ১২ বছর।

কবিতা আশ্রম: কবিতা লিখতে আসা কেন?
অঙ্কুর মজুমদার: শুধুমাত্র শখের কারণে।

কবিতা আশ্রম: এই বইটি সম্বন্ধে কিছু কথা পাঠকদের উদ্দেশে বলুন
অঙ্কুর মজুমদার:অন্ধকারের ঘুণপোকা’ প্রধানত বিচ্ছেদ, বিরহ, আশেপাশের কিছু বাস্তবতা ও মন খারাপের সমন্বয়ে লেখা। যারা প্রেম-ভালোবাসা বিষয়টাকে জীবনে গুরুত্ব দেয়, তাদের মনে কিছুটা হলেও কাব্যগ্রন্থটি দাগ কাটবে, এটা আমার বিশ্বাস। কবিতা সাধারণত পাঠকদের পড়ার জন্য লেখা হয়, তাই সবশেষে বলা যেতে পারে, পাঠকদের ভালো লাগলেই আমার লেখা এই কাব্যগ্রন্থটি সার্থকতা পাবে।

কবিতা আশ্রম: আবহমান বাংলা কবিতায় আপনার বইটি নতুন কী দেবে?
অঙ্কুর মজুমদার: তরুণদের ভালোবাসার ভাঙনের ক্ষত শুকোনোর জন্য আমার এই কাব্যগ্রন্থটি আশা করছি ঔষধের মতো কাজ করবে। আর নতুনত্ব বলতে আশেপাশে সমাজের কিছু বাস্তব কথা স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে এই কাব্যগ্রন্থে পুরোটা জুড়ে।


ইতিকথা পাবলিকেশন, চাঁদপাড়া, ৬০টাকা





বই উৎসব


আমি কত কিছুই পারি না তাই তো! ভেবে দেখলে আমি কিছুই তো পারি না। তবু মৃত্যুকে এড়িয়ে চলতে তো পারি। অঙ্কুর মজুমদার ‘অন্ধকারের ঘুণপোকা’ (ইতিকথা পাবলিকেশন, চাঁদপাড়া, ৬০টাকা)-র মতো আমাদের মাথার ভেতরে এরকম কত-কত না-পারা নিয়ে হাজির হলেন হঠাৎ। দেখালেন, ‘যে মুখগুলো সবচেয়ে প্রিয়/ যাদের ছোঁয়া,/ আদর মমতা/ বিশুদ্ধ শাসনে ধোয়া;’ এইসব, এইসবও, কিছুই কিছু নয়। কেবল পরিবার, সেই তেল-হলুদ মাখা আঁচল পেতে বসে থাকা আমার মা, অসুস্থ বাবা, ভাই...এই আমাদের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। তথাপি গোধূলিটা দূর সীমান্তে আত্মগোপন করে, আমাদের বিশ্বাসকে ছাড়িয়ে বড় হয়ে ওঠে সমাজের বলে-দেওয়া, বানানো স্বপ্নগুলো। কী সহজে অঙ্কুর বলে উঠছেন, ‘তোমার সুযোগ ছিল এই মনটাকে রক্ষা করার’, কেবল প্রত্যাশা বড় হয়ে উঠছিল...ভাগ্যিস বুকের ভেতরটা কেউ টের পায় না।’ আপনি পেয়েছেন, অঙ্কুর। 
---‘আমাকে মুছে দাও, অবহেলায়...’/ পাঠক সেনগুপ্ত / কবিতা আশ্রম (মুদ্রিত)/ জুন ২০১৮


অলংকরণ:মণিশঙ্কর




।। উপেক্ষিত আপেক্ষিক শব্দগুলি দূর দ্বীপে চলে গেছে: আদিত্য মুখোপাধ্যায় ।।



আদিত্য মুখোপাধ্যায়





বই উৎসব

ফুলমণি সুপলের স্মৃতি আর গোধূলি গ্রামের হারানো কথাচিত্র দিয়ে ভরা পনেরোটি কবিতা বই-এর নির্বাচিত ‘শ্রেষ্ট কবিতা’ (একুশ শতক, কলকাতা, ২৫০ টাকা) আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের প্রায় চার দশকের কবিতা-সাধনার দলিল। সেই কবে চার দশক আগে কবি বলেছেন, ‘বিশ্বাসের যুগ নয় হে রাজন! বহুদিন অভিধান হতে/ উপেক্ষিত আপেক্ষিক শব্দগুলি দূর দ্বীপে চলে গেছে/ নির্বাসনে।’ আজও সেই ছবির কাছে একই ভাবে বসে আছি আমরা।
একুশ শতক, কলকাতা, ২৫০ টাকা

 কেবল বদলে গেছে বসতবাটি, গ্রাম জনপদ, বর্ষাপাখি, লাবণ্যলতা... তার ‘স্বপ্নের আকাশে ভাসে গাছেদের ছায়া’ আর দূর দিগন্তে দিকবধূদের ডাক শুনতে শুনতে কবি পদ্ম-শালুক তুলে চলেছেন। একজীবনের এই আশ্রয়, এই স্বপ্ন, এই পাতার-ফাঁক গলে মুখে এসে লাগা ভোরের প্রথম রোদ্দুর তাঁর কবিতার সমস্ত জুড়ে। কবি সেই রোদ্দুর ছড়িয়ে দিলেন, আর ‘ছায়াটি তোমার বুক জুড়ে জেগে আছে।’
----‘আমাকে মুছে দাও, অবহেলায়...’/ পাঠক সেনগুপ্ত / কবিতা আশ্রম (মুদ্রিত)/ জুন ২০১৮

অলংকরণ:মণিশঙ্কর



।। আমাদের অস্থিরতায় একটিই জোঁক: অভিমন্যু মাহাত ।।

অভিমন্যু মাহাত 




বই উৎসব

‘আমাদের অস্থিরতায় একটিই জোঁক/ সন্তর্পণে ছুঁয়ে আছে পতঙ্গের ন্যায়।’ শুধু সেই অস্থিরতার পাশে শান্ত বসে আমাদের আর গায়ে মেঘ মাখা হল না। জানা হল না, কেন ভুবনডাঙায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যের তারাটি। কী সেই সন্দেহ, কী সেই অস্থিরতা। একজীবনে সেই নীরব সন্ধ্যাতারাটির নিকটে যাওয়া তো দূর, ভাবলে অগাধ জলে আমাদের এই সামান্য জীবন ভেসে যাচ্ছে। আর অভিমন্যু মাহাত এইসব শহুরে আয়োজনের দূরে বসে ভেজা উনুনে ফুঁ দিতে-দিতে দেখছেন এমন নিদাঘদিনে কেউ একটুও কাছে আসেনি, কেউ আড়ালে ওড়াচ্ছে না চুম্বন। 
আদম, নদীয়া, ১০০ টাকা

টেরাকোটার মন্দিরে কেঁদে ওঠা বিষ্ণূপুরের মৎস্যপুরাণের ছবি আঁকতে-আঁকতে একমনে তন্ময় কবিকে আমিও দেখছি ‘খিলিপান’ (আদম, নদীয়া, ১০০ টাকা) মুখে দিয়ে হেঁটে চলেছেন সুবর্ণরেখার দিকে। এই শহরের গোপনকথা একা শুনবেন বলে কবি অপেক্ষায় আছেন। ‘যেদিন নীরব হবে সব, জলাধার শুকিয়ে যাবে’, আমাদের বরষার নীচে ‘ওই যে নিরুদ্দিষ্ট লাউতন হাওয়া!’ সেখানে কি একটা আয়োজন পেতে পারি যেখানে দেখব স্নিগ্ধ ‘উড়ে যায় দুধপিঠে, দাঁত মাজে শালিখগ্রাম’? অভিমন্যু, আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।
----‘আমাকে মুছে দাও, অবহেলায়...’/ পাঠক সেনগুপ্ত / কবিতা আশ্রম (মুদ্রিত)/ জুন ২০১৮

অলংকরণ:মণিশঙ্কর



।। সব কবিতাই তো আসলে জীবনের অনুবাদ: গৌরব চক্রবর্তী ।।


গৌরব চক্রবর্তী 



আলাপন


কবিতা আশ্রম: কবিতা-যাপন কতদিনের?
গৌরব চক্রবর্তী: ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে কবিতা লেখা নিয়ে উন্মাদনা শুরু হয় আমার মধ্যে। আমি তখন আলিপুরদুয়ার শহরে। তার আগে স্কুল-কলেজে পড়াকালীন ছড়া জাতীয় কিছু একটা লেখার চেষ্টা করতাম। তারপর ২০১১ সালে প্রথম কবিতা ছাপা হয় আলিপুরদুয়ার থেকে প্রকাশিত 'উত্তরের সৃজন' নামক পত্রিকায়। সম্পাদক ছিলেন আমার বর্তমানের অভিন্নহৃদয় কবিবন্ধু শৌভিক বণিক।


কবিতা আশ্রম: লিখতে আসা কেন?
গৌরব চক্রবর্তী: জানি না ঠিক! হঠাৎই! আসলে আমার মনে হয় যে, আমাদের সকলেরই কিছু বলার থেকে যায়, জানানোর থেকে যায়, সবকিছু প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির পরেও-----যেটা হয়তো নিজেকেই বলা বা জানানো। একটা অশান্তি মনের ভেতরে বয়ে বেড়ানোর চেয়ে সেটিকে শব্দে অনুবাদ করা, তার মুখোমুখি বসা, নিজের মুখোমুখি বসা----এটাই হয়তো প্ররোচনা দিয়েছিল কবিতা লিখতে। তারপর থেকে তো কবিতাই নিয়তির মতো করে পরিচালনা করে গেছে আমার যাপন ও জীবন।


কবিতা আশ্রম: 'ভ্রমণবল্লভ' বইটি সম্পর্কে নতুন কিছু কথা।
গৌরব চক্রবর্তী: 'ভ্রমণবল্লভ' আমার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ। এর আগে আরও চারটি কবিতার বই আমার প্রকাশিত হয়েছে। সব কবিতাই তো আসলে জীবনের অনুবাদ, অভিজ্ঞতার-অনুভবের আর স্মৃতির সংকলন-----তবুও বলব, এই বইয়ের নামকবিতার সিরিজগুলো আমার লিখতে আসার শুরুর দিকের কবিতা সব। অবশ্য এর বেশিরভাগ কবিতাই আমার সেই লিখতে আসা শুরুর দিনের কবিতা-----যেগুলো বহুকাল ধরে আগলে রেখেছিলাম দিনলিপির মতো করে। এখানে সেগুলো ছড়িয়ে দিলাম অবশেষে।


কবিতা আশ্রম: এই বইটি নতুন কী দেবে?
গৌরব চক্রবর্তী: জানি না নতুন কী দেবে। তবে এই বইয়ে থাকা কবিতাগুলো সবই গদ্যের আকারে লেখা। এখানে জোর করে চাপানো কোনও বাহুল্য নেই। বলা ভালো, আমার কবিতাগুলো হল আমার জীবন ও যাপনের, অভিজ্ঞতামালার আর্দ্রবিষাদের কোরাস। এটুকুই...বাকিটা পাঠক বলবেন।



শব্দসাঁকো, পূর্ব মেদিনীপুর, ১০০ টাকা




বই উৎসব


 ‘...ভাষার ভেতর থেকে, রক্তের ভেতর থেকে, শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের ভেতর থেকে, যতি-চিহ্নের ভেতর থেকে’ কবিতা কুড়োতে বের হয়েছেন গৌরব চক্রবর্তী। বেরিয়েছেন ‘একটা জ্যান্ত কলম’ নিয়ে। তাঁর সেই বেরিয়ে পড়া, গোধূলির ডাকনাম ‘ভ্রমণবল্লভ’ (শব্দসাঁকো, পূর্ব মেদিনীপুর, ১০০ টাকা)। কয়েক প্রহর শ্রাবণের বীজ ছিল চোখে, কিছু মেঘ অনিশ্চিন্ত ঠেকেছে, নিজের কাছ থেকে পালাচ্ছেন তিনি, তবু, কবিতার উপরেই শেষ পর্যন্ত ফিরে আসছেন। ধীর লয়ের চাহুনি দিয়ে কবিতা ছুঁয়ে রেখেছে, আর সেই চাহুনির ভেতরে নিজেকেই লিখে চলেছেন কবি। কেবল এই বিশ্বাস, যে ‘আমার পুনর্জন্ম বাঁক নিয়ে তোমার সুখের থেকে দূরে, ফেরত চলে যাবে...’
-----‘আমাকে মুছে দাও, অবহেলায়...’/ পাঠক সেনগুপ্ত / কবিতা আশ্রম (মুদ্রিত)/ জুন ২০১৮ 



অলংকরণ:মণিশঙ্কর



।। মনে হয়েছিল, মানুষের কাছে নিজের কথা, বিশ্বাস, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে পৌঁছোনো দরকার: সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়


সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় 



আলাপন

কবিতা আশ্রম: আপনার কবিতা-যাপন কতদিনের?
সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়: কবিতা বহুকালই নিজের জন্যে লিখতাম। ছাপানো শুরু করেছিলাম দেরি করে, তাও ১১ -১২ বছর হয়ে গেল, ঘটে গেল বহু রদবদল, ভাঙচুর, ছায়া হয়ে গেল বহু উপকথা। সাতটা বই জুড়ে কী যে লিখে গেলাম বুঝি না, বোধহয় কিছুই না, ‘তোমার কবিতা থেকে যাবে’---- ইত্যাদি কথাবার্তাতেও বিশ্বাস করি না, কারণ থেকে গিয়েই-বা কী হবে যখন আমরাই আর থাকব না একদিন। তবু, ভ্রমণকালে, পথচলতি নুড়িপাথর আর রোদের স্যাক্সোফোন কুড়োতে-কুড়োতে, বাজাতে-বাজাতে কিছু অক্ষর কোথাও রেখে যাওয়া প্রয়োজন মনে হয়েছিল। তাই এই  কবিতা-যাপন। 

কবিতা আশ্রম: কবিতা লিখতে আসা কেন?
সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়: একটা সময়ে মনে হয়েছিল রোজকার কথোপকথনে সব কথা, যা বলতে চাই, যেভাবে বলতে চাই, ঠিক বলে উঠতে পারছি না। সেইসব কথার গলিঘুঁজিতে নিজেই ঘুরেফিরে মরছি। তখন মনে হয়েছিল, মানুষের কাছে নিজের কথা, বিশ্বাস, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে পৌঁছোনো দরকার। কোথাও একটা সেতু গড়েতোলার প্রয়োজন।  তাই হয়তো কবিতা লিখতে আসা। 

কবিতা আশ্রম: এই বইটি সম্বন্ধে কিছু কথা পাঠকদের উদ্দেশে বলুন।  
সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘দুঃখী বাঘের থাবা আঁকা’ হিসেবমতো আমার সপ্তম বই, তবে বইটি চার ফর্মার নয়, তুলনায় কৃশকায়, দু-ফর্মার। আমার কবিতার বই নিয়ে আমার বিশেষ কিছু বলবার থাকে না সাধারণত। এই বইটির কবিতা গত দেড়-দু বছরে আমার জীবন যেভাবে পালটেছে, আমার চারপাশে যা-কিছু বদল ঘটেছে, এবং সেইসব বদলকে আমি কীভাবে আত্মস্থ করেছি বা বর্জন করতে চেয়েছি----এই সবকিছুর প্রতিফলন, এই ভাবে বলতে পারি...

কবিতা আশ্রম: আবহমান বাংলা কবিতায় আপনার বইটি নতুন কী দেবে?
সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়: তা জানি না। তবে এইটুকু বলতে পারি যে, আমি জানি, বইটি কিছু  মানুষের ভালো লেগেছে, এবং এটা আমার কাছে বড় পাওয়া। আবহমান বাংলা কবিতার মহাকাশে হয়তো এই বইটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক তারার ঝাপসা আলো, হয়তো-বা তাও নয়। ‘ইতিকথা পাবলিকেশন’ এই বইটি খুব যত্ন নিয়ে করেছে, তাঁদের ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। এই ডিজিটাল যুগে এখনও অনেকে কবিতা লিখছেন, কবিতা পড়ছেন, কবিতার বই করতে এগিয়ে আসছেন----এ আমার কাছে আশা আর আনন্দের কথা। 



ইতিকথা পাবলিকেশন, চাঁদপাড়া, ৬০টাকা




বই উৎসব

‘প্রতিটি বাড়িরই কিছু কাহিনি থাকে’। জানি। কিন্তু খুঁজতে বসা যে কী কঠিন! আর একবার সেই বাড়ি ছেড়ে গেলে কাহিনিও হারিয়ে যায়, আর ফেরে না। সেই শহর-বাড়ির হারানো কথা নিয়ে, ছেলেবেলার হারানো পেনসিল-খাতায় ‘দুঃখী বাঘের থাবা আঁকা’ (ইতিকথা পাবলিকেশন, চাঁদপাড়া, ৬০টাকা)-র অবাক প্রচেষ্টায় নেমে পড়লেন সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সব অভিজ্ঞতা, প্রেম সম্বন্ধে নির্ভুল যত ধারণা নিয়ে কী অবসরে নিজের সামনে এসে দেখেন ‘বন্য গোলাপের ঘ্রাণ তুলে এনে/ যথারীতি, হিরণ্ময় বালক হয়ে’ যাচ্ছেন কবি। আর পাঠক, এই জীবনের সোনার হরিণ খুঁজে-খুঁজে নাকাল ব্যস্ততা থেকে সামান্য অবসর পেয়ে একবার বসলে, সিরিয়াস চশমা খুলে তাকালে, আপনিও হরিণ হয়ে যেতে পারেন। 
-------‘আমাকে মুছে দাও, অবহেলায়...’/ পাঠক সেনগুপ্ত / কবিতা আশ্রম (মুদ্রিত)/ জুন ২০১৮

অলংকরণ:মণিশঙ্কর 



।। আঙ্গিকটিকে ঘিরে অজস্র জিজ্ঞাসার চিহ্ণ ভিড় করে সেলফির চতুষ্পার্শ্বে: রফিক উল ইসলাম ।।


রফিক উল ইসলাম 




আলাপন
কবিতা আশ্রম: আপনার কবিতা-যাপন কতদিনের?
রফিক উল ইসলাম: 





কবিতা আশ্রম: কবিতা লিখতে আসা কেন?
রফিক উল ইসলাম: 




কবিতা আশ্রম: এই বইটি সম্বন্ধে কিছু কথা পাঠকদের উদ্দেশে বলুন। 
রফিক উল ইসলাম: 



কবিতা আশ্রম: আবহমান বাংলা কবিতায় আপনার বইটি নতুন কী দেবে?
রফিক উল ইসলাম: 







সিগনেট প্রেস, কলকাতা, ১০০ টাকা





বই উৎসব


‘আমি কবিতাকে, / কিংবা কবিতাই যখন গড়ে তুলবে আমাকে, সেদিন যেন/ ওই ধর্ম পরাস্ত করে দেয় ইব্‌লিশের গরিমা। যেন/ সেদিন থেকেই ঈশ্বর ঠিকঠাক শিল্পী হয়ে ওঠেন।’ এরকম কথা বলতে আজকাল তো কাউকে তেমন শুনি না। শুনি না বলতে, ‘আমি তো কেয়ামত পর্যন্ত পাহারা দিতে থাকব / তোমাকে’। চারদিকের সেলফিয়াইটিসে আক্রান্ত দুমদাম ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের ইনবক্সে কে আপনি রফিক উল ইসলাম, একা বসে ‘অবসরের পর সেলফি’ (সিগনেট প্রেস, কলকাতা, ১০০ টাকা) নিতে-নিতে ক্লান্ত হলেন না আজও? কী করে ভেঙেচুরে প্রসারিত করে চলেছেন নিজেকে এই ধর্মান্ধ সময়ে? কী করে বাঁচিয়ে রাখছেন নিজের ভেতরের নিজস্ব, একান্ত মানবিক ধর্মকে? বোধকে? আর এত কিছুর পরেও অক্লেশে বলে চলেছেন, ‘আমাকে মুছে দাও, অবহেলায়...’ এই কবিতাগুলোর প্রত্যেক অক্ষর ‘সীমাহীন অরণ্য ঘুঙুরের মতন বাজে’। আর কবিকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে, ‘গোটা ভারতবর্ষ পায়ে-পায়ে সঙ্গে নিয়ে’ আপনি চলতে থাকুন, চলতেই থাকুন...
-------‘আমাকে মুছে দাও, অবহেলায়...’/ পাঠক সেনগুপ্ত / কবিতা আশ্রম (মুদ্রিত)/ জুন ২০১৮  



অলংকরণ:মণিশঙ্কর 

।। কবিতা আশ্রম ব্লগজিন ।। তৃতীয় সংখ্যা ।। ডিসেম্বর ২০১৮ ।।

শিল্পী: চন্দন মিশ্র                                                           কথা    ফের নকশিকাঁথার ভাঁজ খুলে মাঠে-মাঠে অঘ...