কবিতা আশ্রম-এর জুলাই সংখ্যা
২০১৮ (মুদ্রিত) থেকে:
কতবার ভেবেছি, পুনর্বার জেগে উঠি
পাঠক সেনগুপ্ত
‘আমরা যারা বেড়েছি
কাঁটালতা ঝোপঝাড় ছুঁয়ে কুঁড়েঘর’,
তাদের পিছলা আস্তিনভরা স্যাঁতসেঁতে কচুরিপানা, আর বানানো নদীর ঘোলাটে জলে ডুবে
থাকতে-থাকতে খেয়াল করা হয়নি, কবে কীভাবে এই নগরীর একটি মেয়ের চোখের পরদায় নেমে এসেছিল ঘর, ব্যর্থঋতুর নানা স্বপ্নভঙ্গিমা। আর পোড়াস্বপ্ন, পোড়ানদী পার হতে-হতে ‘ছায়ার ভিতরে মায়ামৃগের চোখে’ আমরাও কেউ বিষখালি,
আবার কেউ-বা কীর্তনখোলা নদী হয়ে বেঁচে থাকলাম একটা আস্ত জীবন। ‘আমরা যারা অনন্তের পথে হাঁটছিলাম,’ বা অন্তত হাঁটছি
বলে মনে করেছিলাম, সেই সুদূরের এক বন্ধু, শামীম রেজার কবিতা সংগ্রহ (চৈতন্য, সিলেট, বাংলাদেশ, টাকা ৩৩০) আসলে এক অনন্ত
পথপরিক্রমার নদীকথা। এই গ্রন্থের পাতায়-পাতায়, শব্দে-শব্দে দুরন্ত এক মনখারাপিয়া
বাঁশির কেবল নিজের সুরে কেঁদে-কেঁদে যাওয়া। ‘আসলে
ধ্যানী নদী শুধু একা পৌঁছবে স্বপ্নসমূদ্রের মোহনমোহনায়...’ বলে শামীমের ‘পাথরচিত্রে নদীকথা’ শুনতে-শুনতে শুরু হল এই
পরিক্রমণ। পথে যেতে-যেতে আমাদের কেবল আপন বৃক্ষসৌন্দর্য চেনা হল না, দীর্ঘপথ পার
হয়ে গুহাচিত্রের নানা মানুষের সঙ্গে দেখা হল,
কেবল জলমগ্ন হেমন্তের প্রলয় নিয়ে দাঁড়ানো রাত্তিরের কাছে কীভাবে কামাতুর লোভী বেড়াল চিৎকার করে, শোনা হল না আমাদের। ‘আপনি শুনলেন কীভাবে?’ শামীম? কী সহজে বললেন, এই
লোভাতুর, কামজর্জর বেড়ালের পৃথিবীতে ‘বেঁচে আছি শূন্যতার বিষাক্ত খেলনায়...’ আর এই
শ্রাবণমুষলবৃষ্টিদিন দেখে জীবনের সমস্ত জ্যোৎস্নাপাখি চলে যেতে-যেতে ফিরে আসবে,
ভেবে দেখছি কেবল ‘ছিন্ন পালক পড়ে আছে চুপ’। আমাদের পুঁথিচিত্রকর হয়ে সেসব পড়ে-থাকা লিখে যাচ্ছেন শামীম, নিরন্তর...
একবার দোলের মেলায় অচেনা সুরের নদী এসে ভর করলে
আমরা আবার স্বপ্নের গন্ধে পাগল হয়ে উঠলাম। নিজেদের ভিতর ও অনুভূতির ভিতরে বসে থেকে পার করলাম কত যুগান্ত, কেবল সাধনা জানি
না বলে দেখতে পাইনি তাকে... দেখতে পাইনি কেমন তাঁতিবউ শাড়ির পাট খুলছে আর সেই পাটে পাটে আমার অনন্ত বঙ্গদেশ পরিচিত মুখ নিয়ে আজও অমলিন। থুরথুরে সন্ধ্যা হেঁটে যায়, আর নিজেকে হারিয়ে
খুঁজি চেপে-ধরা এক নিঝুম-নিঃসঙ্গতায়। ‘আমরা কি রাত্রি-বিলাসী গাঙচিল?’ ভাবতে-ভাবতে স্মৃতির
সুবর্ণনগরে রাত্তির নেমে আসছে। ‘রাত্তির নাইম্যা আসে
মনের গভীরে আমার,’ আর শৈশবের শুকতারা কানে-কানে বলে যায়, ‘বলো তোমায়, কীভাবে স্বপন দেখাই।’ এই রাত্তির জুড়ে হেতাল
বনের আঁধার, শৃঙ্খলের শিকল-পরা শাপভ্রষ্টা দেবীকার
মুখ, যুবতী মাংসের ঘ্রাণ গলে পড়ে, আর তারাদের স্নান সেরে উঠে-আসা এক রাত্তির অপেক্ষা লেখে আমাদের বসন্তদিনের
খাতায়, নদী নিদ্রাহীন ঘুমায় আলোর আঁধারে।
শামীম রেজা |
শামিম লেখেন সেই ‘মর্গের
দুয়ার থেইকা ফিইরা-আসা লাশ আমি গ্লোবাল এন্টিনায় নিজেরে শুকাই’। নিজেকে অতীত করে, আত্মঅভিমানের এত যে খেয়ালে মেতেছি
আমরা, আমাদের কি মনে পড়ে না সেই দুঃখের স্বনির্মিত স্বরগ্রাম? বনপথ-মায়ার ভেতরে
চলতে-চলতে কি হঠাৎ কোনও উদাস চোখের দিকে তাকালে মনে হয় না ‘তুমি দূরতম সঙ্গীত’? কেবল তোমার উদাসীমায়ার কাছে এসেও আমরা,
নিজেদের এত্ত এত্ত বড় ভেবে-ভেবে ‘ছেনালী
আশায় চোখ খুলতে বলি’ নির্জনতম নারীপ্রতিমাটিকেও। বলতে কি ইচ্ছে করে না, ভাবতে কি ভালো লাগে না ‘বধূয়া আমার সান্ধ্যপাখির দলে, ধাঁধাময় পাহাড়ে থাকে, পথের
বাঁশি হৃদয় মাঝে কাঁপে কোপাই নদীর
বাঁকে...’?
নিশ্চয়ই মনে হয়, আর বিস্ময়ে সেই নিজের বিশ্বাস প্রকাশ
না-করার শহুরে-অভিমানে আরশিনগরের দিকে যেতে-যেতে কোজাগরি রাত্তিরে খুঁজে ফিরি তাকে... সেই
স্নিগ্ধনারীপ্রতিমা অথবা হারানো নদীটিকে।
শামীমের মতো আমাদেরও
‘মেজাজটা খারাপ হয়া যায়, অমাবস্যা আইসা হাঁটু গাইড়া বয় পাশবারান্দায়,...’
তবু ব্রহ্মাণ্ডের স্কুল খুলে বসে কবি শুধু
ব্যক্তিগত নরকে দগ্ধ হওয়া নীল অর্কিড নন। ‘কতবার ভেবেছি
বৃক্ষজন্ম কিংবা পাখিজন্ম হতো যদি আমার/ তোমাদের জলে অবগাহন শেষে পুনঃ পুনঃ জন্ম
দিতাম আবার’। সে-জন্ম নিশ্চয়ই ব্রহ্মাণ্ডের স্কুলের, আর শামীম এক প্রদোষের
জাদুকর, আমাদের দেখাচ্ছেন, ‘ওই দেখো জঙ্গল সমস্ত প্রাণীসহ চিৎ হয়া শুইয়া আছে
আমার ডানায়, ঘুমপোকাদের ভিতর-বাহির কি এক অদ্ভুত পোড়াগন্ধ’...এই গন্ধ আমাদের অস্তিত্বের পুড়ে যাওয়ার? না-কি স্বপ্নের পুড়ে যাওয়ার? না-কি তাঁর সঙ্গে আমরাও বলতে পারব, ‘এতদিন পরে আমি জেনে গেছি সমস্ত জ্যোতির্ময় গোলক পাওয়া যাবে
আমার আত্মার ভিতর — আর এই জ্যোতির্ময়
গোলকের ভিতরই আমার আবর্তন।’ আজ এই অদৃশ্য আততায়ী-সময়ে নিজেদের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, ‘আমাদের চোখগুলো নিয়া যারা মার্বেল খেলেছে মধ্যদুপুরে
পশ্চিমপাড়ায়, তাদের কথা এবার থাক, পাগল হবার পূর্বে সে চোখ বন্ধ কইরা হাঁটতো আর
মধ্যরাতে একা লাল ঘোড়া তার বুক থেইকা বাইর কইরা তার পিঠে চইড়া মিলায়ে যেত দূর
টিলার উদিত রেখায়,...’ আমাদের সেই দূর টিলার খোঁজে এখনও অনেক রাত্তিরপথ
হাঁটা বাকি।
এই আপন মমির খোঁজে নেমে, নিজের অনেকানেক পাথরের সঙ্গে প্রত্যেক সাফল্যের সঙ্গে দেখা হতে-হতেও কী যেন বাকি রয়ে গেছে। বুকের গভীরে কোনও এক পলাতক পাখি ডেকেই চলেছে ভোর থেকে জোছনারাত্তিরময়। নিজেকে গোপন রেখে আপন বাসনামতে এই যে নিজেকে গড়ে নেওয়া আমাদের ‘এই ভালো, সেই ভালো’ জীবন, আমাদের কেন মনে হল না, শামীম, কেন বলতে পারলাম না, ‘যে তুমি শিকারি, সেই তুমিই যে নিহত শিকার।’ মনের গভীর ডালে বসেছে দুরন্ত এক পাখি। আমাদের এসমস্ত জীবনের সব গাছে আমাদের চোখের সামনে ফোটা ফুলেরা ক্রমে ফল হয়ে গেছে, ‘ফলের মধ্যে ঘুমন্ত বীজেরা আলোর খোঁজে’ যে আমাদের মুখ চেয়ে বসে আছে কোন অতীত থেকে, আর ফুলরেণু উদ্ভাসিত এই যে জীবনের প্রার্থণাগৃহ, এত মুখরের কাছে এসে দেখছি, ‘আমাকে মানুষ করবে দায়িত্ব নিয়েছিল যে নগর/ তার হৃদয় ছিল না কোনো;/ সে ছিল গুপ্ত নিশ্চিন্ত-ঘাতকের ঘর।’ আমরা সে-ঘর দেখেছি, সেখানে জীবিত শবেরা ঘাতক চোখে চেয়ে আছে আর আমরা কী ভীষণ চিৎকারে একটু শ্বাস নিতে-নিতে বলতে পারছি, ‘বেঁচে গেছি এমন পৃথিবীতে চোখ খুলিনি বলে।’ চারিদিকে নির্ঘুম রাতের আবর্তন। কত সায়র সময় পার হলে আমরা আপনার সমান মানুষ হব, শামীম?
দুই
‘পরবর্তী
আলোচক শুরু করবেন এখান থেকে’। কোথা থেকে শুরু করব, অনিকেত? আপনার ‘শব্দ-নৈঃশব্দ্যের অনুরণন’ আমাদের আলোকিত করে বসে থাকে। আমাদের এই ক্লেদাক্ত
জীবন, এই মুখোশপরা মহাশয়-অস্তিত্ব, নিত্যদিন কথামালা তৈরি করে এগিয়ে যাওয়া, নাটকীয়
ভঙ্গিতে ক্রমশ বিন্দু থেকে গড়িয়ে পড়ার কাছে এসে আপনার কাছেই শুনলাম, ‘একটা বৃত্ত আঁকার চেষ্টায় বারবার ব্যর্থ তুমি’। আমাদের এটা-সেটার জীবনে নিজেকে ঘিরে রচনা করা
বৃত্ত কবে বড় হতে-হতে মহাবৃত্ত হয়ে উঠছি আমরাই, সে-খোঁজ যে রাখা হল না। বলা হল না
মন খুলে, এই জীবনের ‘সবকিছুই প্রকাশ্য হোক, কেননা
আড়াল আমাদের বঞ্চিত করে।’ তাহলে কোথা থেকে আলোচনা শুরু করব আমরা? ‘এই বোধের অতীত তুমি কীভাবে পৌঁছুবে/ সমস্ত কোলাহল থেমে যায়
এই উপান্তে’? কীভাবে ফেরাব নিজেদের সমূহ পতনসম্ভাবনা? ‘মাথার ভিতর অদৃশ্য দৃশ্যাবলির লিবিড সময়’ ছেয়ে
আসছে। ‘সরীসৃপের মতো এঁকেবেঁকে চলে’ যাচ্ছে
সময়। আর সেই স্বপ্নিল অন্ধকার নিয়ে ভেসে যাওয়া সময়ের অনর্গল প্রতিবেদনের ভাষ্য-ভরা
অনিকেত শামীমের কবিতা (বাংলালিপি, ঢাকা, বাংলাদেশ,
টাকা ৩০০)। এইভাবেই শুরু হয়ে গেছে
চলার কাহিনি লিখে।
আমাদের আজীবনের অন্ধপাতায় জ্যোৎস্নাবিকিরণ দেখতে-দেখতে যে ঘটনা-কাহিনির কাছে এসে বসেছি, তার সংলাপভরা পাতায় পাতায় ‘শুধু দীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিল, নিজেকে উন্মোচনের মৌনব্রত ছিল সান্ধ্যপ্রার্থণার মতো, প্রিয় নারীপ্রতিমার কানে কানে বলার ছিল, কেন আমার ভীষণ কষ্ট হয়। ‘অথচ হৃদয়ে আমার ব্যর্থতার কোনো গ্লানি নেই/ চিরকাল একা থাকার ভয় আমার মধ্যে নেই।’ আর, এমন একটা দিনের কথা ভাবুন, এমন সেই মুহূর্ত, ‘তখনো পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছোয়নি’, নিজেদের উন্মোচন ভেঙেচুরে খোঁজা শুরু হয়নি একটাও পথ। ধরুন, একদিন নিজেকে আপনি নিজের সামনে নানান সাজানো আয়নায় দেখতে-দেখতে হঠাৎ মনখারাপের সুরে বলে উঠলেন, ‘ও মন তুই কদ্দুর যাবি?’ সেইদিন অনিকেত যদি আপনাকে পালটা জিজ্ঞেস করে বসে, ‘কতদূর যেতে পারেন আপনি?’ তাহলে কী বলবেন, হে পাঠক? আমি তো বলব, ‘বেদনার ক্ষত বুকে নিয়ে কতদূর যাওয়া যায় বলো?’
অনিকেত শামীম |
অনিকেতের ‘ছুঁয়ে দিই কিংবা স্পর্শের অতীত’ অনেক না-বলার মধ্যে জেগে উঠেছে মৌনপাথর হয়ে। তার কল্পনার আকাশে অন্ধকার ছুঁয়ে যায় অসংখ্য বাবুই। আর বুকের খুব কাছে নিবিড় হাত রেখে কবি বলে যান, ‘তোমার যত কষ্ট/ জমা দাও আমার হৃদয়ের কষ্টব্যাংকে। সুদে আসলে ফেরত দেবো সুখের কড়কড়ে চেক’। আহা, এই নীলকণ্ঠ আহ্বানের কাছে নত হতে যে কী সুখ, কী জ্যোৎস্নার মায়া! আনন্দ হয়। সহজ জীবনের আনন্দ। কিন্তু কবি আমাদের দুঃখদিনের বন্ধু। ‘তোমার আনন্দের(?) দিনে দূরে থাকা ভালো, কেননা অহেতুক চারপাশের পরিবেশ বিব্রতবোধ করবে’ বলে তিনি দূর থেকে এই জীবনকে দেখছেন। এই জীবন, মানে ‘বেহালার তার ছিঁড়ে যাওয়া ভালোবাসা’। এই ‘জীবনের হিসেব মেলাতে গিয়ে একজন কেরামত আলি রক্তের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস টেনে আজীবন পালিয়ে যায়’। তবু, যাওয়া বললেই যাওয়া হয় না। দ্বিধাদ্বন্দ্ব, স্নায়ুযুদ্ধ বড় কঠিন। তার কাছে এসে অনিকেত বারবার বলছেন, ‘অদ্ভুত আলোয় হেসে ওঠো’। বিশ্বাস করতে শেখো, একদিন হয়তো ঈশ্বরকে তাক লাগিয়ে ঘোষণা করতে হবে আমাদের মৃত্যুর উপর কারও হস্তক্ষেপ থাকবে না। আর আমরা এই কবিতাজীবন সঙ্গে করে হাঁটতে-হাঁটতে পৌঁছে যাব সভ্যতার নতুন আবাসভূমিতে। সেই ভূমির বাগানে একটিই ফুল। ভালোবাসার। মানুষের। সেখানে দূরে-কাছে বলে কিছু নেই। নেই অন্ধ বালকের প্রতি ঈর্ষাও। জীবনের সবকটা দরজা খুলে সেখানে বলতে হবে না, ‘আমাকে আমি চিনতে পারিনি আজও’। ভাবুন, এরকম একটা বিশ্বাসের কাছে আমরা এসে গেছি সবাই। আর সেই অস্তিত্বের কাছেই আছেন অনিকেত। বলতে পারছেন, ‘এই তো বাড়িয়েছি হাত/ সমস্ত ভয়, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছেড়ে বাড়ালাম হাত’।
আমরাও হাত বাড়িয়েই রইলাম।
No comments:
Post a Comment