Wednesday 5 December 2018

।। গল্প: হলুদ অ্যালবামে নিহত নীল: সন্মাত্রানন্দ ।।




হলুদ অ্যালবামে নিহত নীল 

 তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল স্কুলে, আমি যেখানে কাজ করতাম, সেখানে...আমার অফিসে।
           যতটা মনে পড়ছে সঙ্গে ছিলেন নন্দিতা দত্ত, নন্দিতার স্বামী সুরজিৎ, কেয়া দেব, আরও দু চার জন। ত্রিদিবদা এসেছিলেন এঁদের বন্ধু বা দাদা হিসেবে। প্রথম দর্শনেই আকৃষ্ট হওয়ার মত তাঁর মুখের বুদ্ধিদীপ্ত ভাব। চশমার আড়ালে তীক্ষ্ণ সহাস্য দুটি চোখ। রোগা, ফর্সা, শার্প চেহারা আর একটি সরল বালকের মত হাসি, যা সবাইকে অন্তরঙ্গ করে নেয়।
         তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল আবেগময়। ত্রিদিবদা মানুষটাই ছিলেন ওইরকম। অসাধারণ মেধা, বাকচাতুর্য আর সীমাহীন হৃদয়বত্তা মিশলে যা হয়। হাসলে সারা মুখটাই যেন হাসতে থাকে। সর্বোপরি যেটা মনে হয়, তিনি যেন কোনও বয়স্ক মানুষ নন। ঠিক যেন ছটপটে একটি তরুণ। সবসময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
        সেদিনের কথাবার্তা কী হয়েছিল, একটু একটু মনে আছে। বৌদ্ধ দর্শনের প্রসঙ্গ করতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছিলাম, এই ছটপটে বয়স্ক-বালকটির ভিতর একজন সুগভীর জ্ঞানী লোক বসে আছেন।

        ধীরে ধীরে তাঁকে আমি জানতে শুরু করি। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে সম্ভবত স্ট্যান্ড করেছিলেন। পড়তে গেছিলেন যাদবপুরে। তারপর বিদেশে। এই সময়ের কাছাকাছি তাঁর জীবনে প্রথম প্রেম। বিবাহ। বিচ্ছেদ। সম্ভবত, মেয়েটির বাবা ত্রিদিবদাকে ত্রিপুরা ছেড়ে কলকাতা চলে আসতে বলেছিলেন। জোর প্রয়োগ করেছিলেন। আরও অন্যরকম ঝামেলা থাকতে পারে। সঠিক জানি না।
   কিন্তু আসল ঝামেলাটা হল বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে। ত্রিদিবদার একেবারে নিজস্ব আবিষ্কার, মূল্যবান গবেষণাপত্র তাঁর রিসার্চ এক্সপার্টের নামে বেরিয়ে যায়। তাতে ত্রিদিবদাকে বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এই বঞ্চনাটা ত্রিদিবদার মাথায় এসে লাগে। অসম্ভব সেনসিটিভ মানুষ। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন ত্রিদিবদা।
         এসব অনেকটা আগের কথা। আমার সঙ্গে যখন দেখা হচ্ছে, ত্রিদিবদা তখন অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছেন। নরসিংগড়ের পলিটেকনিক কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল। আবার বিয়ে করেছেন। মেয়ে হয়েছে। মেয়ের নাম রেখেছেন অনূষা। মেয়ে-অন্ত প্রাণ ত্রিদিবদা।  
         তাঁর মতন সাহিত্যপ্রেমিক আমি আর বেশি দেখিনি। তিনি তাঁর উচ্ছল জীবনযাত্রার পথ বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনর্গল আবৃত্তি করে যেতেন জীবনানন্দ কিংবা বিষ্ণু দে, এলিয়ট কিংবা অডেন, খ্যাপামি করতেন হাত পা ছুঁড়ে, অভিনয় করে দেখাতেন নানা প্রসিদ্ধ নাটকের সংলাপ, মিমিক্রি করতেন অসাধারণ। আমি বলতাম, ত্রিদিবদা, আপনার আসল গলা কোনটা? কখনও চোখ বুজে শুনলে মনে হয় পাশে অনিল সরকারকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, কখনও মানিক সরকার, কখনও মিহির দেব, কখনও উৎপল দত্ত, কখনও সত্যজিৎ রায় তো কখনও বিগ বি। মশাই, আপনার নিজের গলা কোনটা? অমনি ত্রিদিবদা বেসুরে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে নিজের গলাটা চিনিয়ে দিতেন। 
          গরমের দুপুরে ছুটির দিনে শুয়ে আছি ঘরে। ঘুম নেই। দরোজা লাগানো। হঠাৎ দরোজায় গান শোনা গেল,”আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি, সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকালবেলার মল্লিকা, আমায় চেনো কি?” কখনও বা শুনতে পেতাম, “সন্ন্যাসী উপগুপ্ত, মথুরাপুরীর প্রাকারের তলে একদা ছিলেন সুপ্ত তারপর আবার জোরে চেঁচিয়ে রাজরাজ ওগো, দেখা দাও ধড়মড়িয়ে উঠতাম। দরোজা খুলে দেখতাম, ত্রিদিবদা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। 
           ত্রিদিবদার এই হাস্যকরোজ্জ্বল জীবনের আড়ালে একটা সংগুপ্ত জীবন ছিল। সে জীবন এক পথভ্রষ্ট মিস্টিকের জীবন। মিস্টিসিজমের প্রতি, যোগ-তন্ত্র-প্রাণায়ামের প্রতি গোপন একটা আগ্রহ। গুরুর সঙ্গে একমত হতে পারেননি। সে নিয়ে আত্মক্ষোভ ছিল। সংশয় ছিল। ত্রিদিবদার সে দিকটা আমার মতন করে খুব কমজনই জানেন। আমি বলেছিলাম, ভুলে যান ওসব। আপনার এই উচ্ছল জীবনদর্শন, এই কবিতা, গান, এই হাসি-মজা-ইয়ার্কি এটাই আপনার পথ। ত্রিদিবদা শুনলেন না। কার কথাই বা তিনি কবে শুনেছেন?
        হাইজেনবার্গ, শ্রয়ডিঙ্গারের কাজের সঙ্গে বেদান্তের অনিবার্য মিল আছে। ত্রিদিবদাকে সেই সমীকরণ ভীষণভাবে ভাবাতো। এগুলোতে যেন মগ্ন হয়ে থাকতেন। তারপর কী যে হত, নিজের জীবনের ব্যর্থতার কথা, সমগ্র পৃথিবীর অবাস্তবতার কথা, অর্থশূন্যতার কথা মাথায় চেপে বসত। তখন খুব নেশা করতেন। মদ খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। 
         আসলে যারা খুব হাসতে পারে, যারা তুড়ি মেরে আনন্দপ্রোজ্জ্বলতার ভিতর দিয়ে জীবনের সুকঠোর বেদনাকেও যারা উড়িয়ে দিতে পারে, তাদের চোখেই জীবন ও জগতের অর্থশূন্যতাটা সব থেকে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারাই অন্তিমে উচ্চারণ করে বেদনামজ্জিত বিজড়িত কণ্ঠে, Life is a story, told by an idiot.” আনন্দের ভিতর একটা লুকোনো অত্যাচার আছে, আত্ম-অত্যাচার। তার তুলনায় যারা অপেক্ষাকৃত কম প্রতিভার, অল্প সুখ, অল্প দুঃখের আটপৌরে জীবন কাটায়, তারা অনেক ভালো থাকে, সুস্থ থাকে।
        নেশা করে মাঝরাতে ফোন করতেন ত্রিদিবদা। স্খলিত কণ্ঠে একের পর এক জীবনানন্দের বেলা অবেলা কালবেলা থেকে আবৃত্তি করে যেতেন। শৈলেশ্বর ঘোষ এক বিশেষ অর্থে জীবনানন্দকে ক্ষতিকর কবি বলেছেন। যার উপর জীবনানন্দ ভর করেন, সে আর ওই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে নাএই ছিল মোটামুটিভাবে শৈলেশ্বর ঘোষের অর্থ। আমি আরেক অর্থে জীবনানন্দকে ক্ষতিকর কবি বলব। জীবনানন্দ আধুনিক জীবনযন্ত্রণার অন্তঃসারশূন্যতাকে তুলে ধরে হতাশার গভীর গহ্বরে মনকে ঠেলে দেন। ইতিবাচকতা অবশ্যই জীবনানন্দে আছে। কিন্তু সে অনেক নিরাশাকরোজ্জ্বলতার ছায়ান্ধকার পেরিয়ে। কী অপরিসীম নৈরাশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে যে  ত্রিদিবদা উথালপাতাল স্বরে জীবনানন্দের সাধারণ্যে অপরিচিত  বিষাক্ত পঙক্তিগুলি উদ্গীরণ করতেন, মনে হত আমার মনটাও দান্তের ইনফার্নোর মধ্যে পড়ে জ্বলছে।
             আর তার সঙ্গে গালাগাল, খিস্তিখেউড়। যার উপর যত রাগ ছিল, সব উগরে উগরে দিতেন। আর আমি তো তখন তাঁর অনিবার্য চাঁদমারি! যা তা করে গাল দিতেন আমাকে। আবার একটু পরেই, “সরি, সরি। তোমাকে গাল দিয়ে ফেললাম। আপনি কিছু মনে কোরো না। হ্যাঁ? আমি একটু খেয়ে ফেলেছি। তারপর কী কথা হচ্ছিল? পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখের কথা? ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন, মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীর কাছে’...কেউ শুনবে? কেউ শুনবে না। এই সব বধির নিশ্চল সোনার পিত্তলমূর্তি, তবু আহা ইহাদেরই কানে...ইহাদেরই কানে অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেল যুবকের দল...’” এই পর্যন্ত বলেই কাচ ভাঙার ঝনঝন আওয়াজ। পড়ে যাওয়ার  শব্দ। ফোন কেটে যেত। বারবার কানেক্ট করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতাম। মাঝরাতে হয়ত উল্টোদিকে কোনও একটা খাটের নিচে মেঝের উপর ঝনঝন করে একটা ফোন বেজে চলত উত্তরবিহীন। 
              এরকমই চলছিল। হঠাৎ একটা অ্যাকসিডেন্ট হল। ত্রিদিবদা মারাত্মকভাবে জখম। জিবি-তে গেছিলাম দেখতে। আমাকে দেখে দারুণ রাগ। কেন আমি তাঁকে এ অবস্থায় দেখতে গেছি। তাঁর সুগার, এরা জানে না, কেন এরা বুঝছে না, পায়ের ঘা শুকোবে না। মাথার কাছে বসে কপালে চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। দেখলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই বাচ্চা ছেলের মত ঘুমিয়ে পড়লেন।
              পা-টা কেটে বাদ দিতে হল। শুনলাম, জয়পুর যাচ্ছেন, কাঠের পা লাগাতে হবে। তারপর এক বিকেলে এসে হাজির। এক পায়ে সামান্য জোর দিয়ে হাঁটছেন। মুখে সেই অনাবিল হাসি। আমার একটা এক্সট্রা সেন্স ডেভেলপ করেছে, সাধু। আমার এই কাঠের পায়ে মশা বসলেও আমি চুলকুনি ফীল করতে পারছি কাঠের পা-টাতে হাত দিয়ে দেখলাম। এরকম জোরে জোরে হাঁটছেন কীভাবে? অসম্ভব মনের জোর বলতে হবে। যেন কিচ্ছু হয়নি। একদম নর্মাল। হাঁটছেন, কথা বলছেন, হৈ হৈ করছেন আগের মতই। মাঝে একবার খালি বললেন, “আমার খালি চিন্তা আমার মেয়েটাকে নিয়ে। আগের মত আর ওর সঙ্গে পার্কে হুটোপুটি করতে পারব না
           নরসিংগড় থেকে ত্রিদিবদা প্রিন্সিপ্যাল হয়ে চলে এলেন হাপানিয়ায় উইমেন্স পলিটেকনিকে। আমাকে খুব নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে সেখানে। গেলাম একদিন। দেখি, কমন রুমে  অপূর্ব সাহা প্রভৃতি অন্যান্য অধ্যাপকদের সঙ্গে লীজারে টেবল টেনিস খেলছেন। ওই কাঠের পা নিয়ে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছেন যুবক অধ্যাপকদের। 
         তবু মাঝে মাঝেই ভীষণ শরীর খারাপ হয়। আবার ঠিক হয়ে যায়। একান্নবর্তী পরিবারে অশান্তি চরমে উঠল একসময়। অভিমানী ত্রিদিবদার মনে হতে লাগল, বৃহৎ সংসারে তিনি তাঁর যোগ্য গুরুত্ব পাচ্ছেন না। মন কষাকষি। একদিন ভয়ানক খেপে গিয়ে ফোন।    
আমি মিশনে সাধু হয়ে যাব। আর বাড়ি ফিরব না।
ধুর, এরকম হয় নাকি?”
আজ স্বামিজী থাকলে তিনি ঠিক আমাকে সাধু হতে দিতেন।
হায় রে! ক্ষ্যাপা খেপেছে। কী করি এখন? বললাম, “আচ্ছা, আচ্ছা! আশ্রমের গেস্ট হাউজে এসে তো কিছুদিন থাকুন। দেখুন কেমন লাগে, না লাগে।
হ্যাঁ, চলে যাব মিশনে। আর বাড়ি ফিরব না। কদিন ওখান থেকেই কলেজে যাব। তারপর সব ছেড়ে দেব কলেজ টলেজ।
              আশ্রম কর্তৃপক্ষকে বলে একটা ব্যবস্থা করলাম। ত্রিদিবদা এলেন। দিব্বি আছেন। একদিন ফাঁকা একটা জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়ে আমাকে তাঁর বিড়ম্বিত জীবনের সব কথা বললেন। শেষে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললেন। পাগলের মত বলছেন, “আমার মাথায় হাত রেখে প্রার্থনা করুন, যাতে আমার সব সংসারজ্বালা মিটে যায়।
আমি বললাম, “ত্রিদিবদা, আপনার মাথায় হাত রাখার কোনও যোগ্যতা আমার নেই। আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ। আমার থেকে আপনার জ্ঞান অনেক বেশি। মানুষ হিসেবেও অনেক উন্নত আপনি। আপনি এমন বলবেন না।
             কিছুতেই শুনলেন না। মাথায় হাত দিতেই হবে। শেষে বললাম, “বেশহাত কেন?  এই যে আপনার কপালে খাচ্ছি চুমো। এবার হল?”  ত্রিদিবদা ছোট ছেলের মত হাত-পা ছুঁড়ে আনন্দে অস্থির হয়ে ডগমগ। হাসি আর থামতেই চায় না। 
             বললেন, “এ নিরালা আশ্রমে আমার আর থাকা হবে না। আমার মেয়ে নাচের ক্লাসে পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছে। মায়ের চোখটা দেখাতে একবার কোলকাতাও নিয়ে যাওয়া দরকার। আমাকে যেতে হবে।
বললাম, “বেশ যান। কিন্তু আবার ফিরে আসুন।”  
           ত্রিদিবদা ফিরে এলেন। দেখা হল। বটতলা মহাশ্মশানে। শায়িত। সাদা কাপড়ে ঢাকা নিথর শরীর।
        কোলকাতায় বোনের বাড়িতে থাকার সময় এক রাত্রিতে সুগারের ওষুধ খেতে ভুলে গেছিলেন। রাত্রে বাড়াবাড়ি হল। সকালে নার্সিং হোমে দেওয়া হয়েছিল। সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু একদিন সকালে স্যালাইনের নলটল খুলে ফেলে চলে এসেছিলেন রাগারাগি করে। কেন তাঁকে এভাবে বন্দী হয়ে থাকতে হবেকেন
         তারপরই সাংঘাতিক বাড়াবাড়ি হল। আর ফেরানো গেল না।
       ত্রিদিবদাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। ফুল মালা চন্দন দিয়ে। মাথার কাছে বসে কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে পড়ছিল সেই অনেকদিন আগে জিবি হাসপাতালে এমনি করে ত্রিদিবদার কপালে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিনের মতই আজও ত্রিদিবদা শান্ত বালকটি হয়ে ঘুমিয়ে আছেন।
         ইলেকট্রিক চুল্লিতে ট্রের উপর শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি পায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছেসেই দুরন্ত শিশুটি ঘুমোচ্ছেন। এখনই তো জেগে উঠতে পারেন। আবার কথা বলতে পারেনগান গেয়ে উঠতে পারেন। ত্রিদিবদা মারা গেছেননানা! অসম্ভব! অসম্ভব! সব্বার উপর অভিমান করে ঘুমিয়ে পড়েছেন তো শুধু। 
         চুল্লীর মুখ খুলে গেল। চলন্ত ট্রে-টা চুল্লীর খোপের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। এখনও তাঁকে দেখতে পাচ্ছি। উপর থেকে শাটার এসে চুল্লীর মুখ বন্ধ হয়ে গেল। আর কোনোদিন ত্রিদিবদাকে দেখতে পাবো না।
         আর কোনোদিন ত্রিদিবদাকে দেখতে পাবো না?
         কখনও মৃত্যুর সামনে ভেঙে পড়িনি। এই প্রথম কান্নায় চুরমার হয়ে গেলাম। পাশেই শুভ্রজিৎ ছিল। ধরে ফেলল আমাকে। গাড়িতে নিয়ে এসে বসাল।
       আমতলি ফিরছিলাম। নিশীথ অন্ধকার। জোনাকি জ্বলছে নিভছে অদৃশ্য কোনও চিত্রকরের আলোক সংকেতের মত। কী সেই আলোকিত ভাষাআমরা জানি না। জীবন-মৃত্যুর কোন্‌ অপার্থিব সংকেত?
         গাড়ির খোলা জানালার মধ্য দিয়ে ঝাপটে পড়ছে বাতাস। অন্ধকার কথা বলছে গম্ভীর স্বরে। কয়েকটা লাইন মনের ভিতর বিদ্যুতের রেখায় কোথা হতে যেন এসে লেখা হতে লাগল:
    
গীটারে তারে টানজীবন জায়মানমধ্যচেতনার আহত সুর
যদিও এইখানে নিঝুম এসে নামে অতর্কিতে গূঢ় রাতদুপুর।
অনেক এলোমেলোকী তাতে এসে গেলোবুকের দরজায় তবুও এই —
জোনাকি বুনে চলে নিপুন নকশায় মধ্যরাত্রির স্বপ্নকেই।
শুষেছে সংকেতে শিরা ও ধমনীতে তীব্র চুম্বনে মুখ্য প্রাণ,
গরল ঢেলে দিই রক্তস্রোতোপথে অমনি জেগে ওঠে অভিজ্ঞান!
এবার খুলে যাবে ভোরের কুয়াশায় আমার অন্তিম যাবার পথ,
ছড়ানো খইফুলে চতুর্বাহকেরা মৃত্যুঘোড়া হয়ে টানুক রথ।
আজও কি সম্ভব পিছন ফিরে দেখা হলুদ অ্যালবামে নিহত নীল?
সুখের স্মৃতিগুলি শুকিয়ে যাওয়া চুলে অন্ধ কপাটের খুলেছে খিল।
এখন হাহাকার বাতাসে ছুটে আসে নিকষ তমসার শূন্যঘর,
এখানে একদিন যদিও আশ্লেষে জড়িয়ে বেঁচেছিলে পরস্পর।
জানি না মরণের আঁধার শেষ হলে কোন্‌ সে আলোকের পাবো বা টের,
জেনেছি এইটুকুজীবন বাজি রেখে বলগা ধরে আছি রথাশ্বের।
গীটারে তারে টানজীবন জায়মানমধ্যচেতনার প্রহত স্বর,

তবুও এইখানে নিঝুমে জমে ওঠে শ্বাপদরাত্রির স্বয়ম্বর।। 



[গল্পটি 'কবিতা আশ্রম' (মুদ্রিত)-এর আগস্ট ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত] 
শিল্পী: চন্দন মিশ্র 


No comments:

Post a Comment

।। কবিতা আশ্রম ব্লগজিন ।। তৃতীয় সংখ্যা ।। ডিসেম্বর ২০১৮ ।।

শিল্পী: চন্দন মিশ্র                                                           কথা    ফের নকশিকাঁথার ভাঁজ খুলে মাঠে-মাঠে অঘ...