( একটি অনুরোধ, পঙ্ক্তিগুলো ভেঙে যাচ্ছে মনে হলে আপনার স্মার্টফোনটি আড়াআড়ি করে পড়বেন। ল্যাপে বা ডেস্কটপে এই অসুবিধা হবে না। কবিতাগুলো কেমন লাগল? মতামত দেবেন, এইটুকু চাইছি।)
চক্রবাক ও পরিনির্বাণকথা
বঙ্কিম লেট
১
আর ঘুম আসে না আমার বাড়ি। ঘুমের পরি
উড়ে গেছে। আমি তাকে অরণ্যে
অরণ্যে খুঁজে ফিরি
বিছানায় ঝরে উল্কা। পুড়ছে রজনীগন্ধার খেত
আমি ক্রীতদাস; পিঠ ভেঙে দিচ্ছে
জলতৃণের বেত
একদিন আসত ঘুম দিনের শেষ পাতাটি
ঝরলে,
মাঠ থেকে সব পাখি গাছের শাখায়
ফিরে এলে
হাতে সন্ধ্যামণি ফুল, বলাকার
পালক খোঁপায়
কোনও দাওয়াত ছিল না। ভাতের গহনে ছিল না
হরিণের নাভি। বিভা ঝরত নিরন্ন
শালপাতায়
মানুষ ঘুমিয়ে গেলে, রাত
সপ্তপর্ণ কথা বলে;
শিশিরের শব্দ ওড়ে ঘাসে, বৃষ্টি-থামা
আস্তাবলে
আমিও টের পেতাম ঘুম পা ফেলছে
শুকনো পাতায়,
বাজত পাতার নূপুর প্রাণে, ত্রিপত্র
কপাটিকায়
জানালায়, ঝরোকায় সে দিত
সেরেনাদের শিস
ঠোঁটের বাতাসে ঢুলত মঞ্জরিত
আমলকীর শিষ
আমার কুটির ছিল বসত বিচ্ছিন্ন।
পলাশের
মীনপুচ্ছ ছায়ায়। দূর-আত্মীয় আমি
কোনও গ্রহের
রাঙামাটির দেয়াল। খড়ের ছাউনি ।
ভাঙা দরজা
বিকল ছিল রেডিও, ছিল ঘুণপোকাদের
তর্জা
পড়শির পুকুর ছিল। হ্রেষা ছিল
ডানাঅলা ঘোড়ার
মাছ ছিল সৌপ্তিকপর্ব রাতের পর
রাত শোনার
চাঁদ বসত ডুমুর গাছে, পিঁপড়ে-খাওয়া
বাতাসার মতো
স্তব ছিল বল্মীকের। বিভাবরী
লণ্ঠনেই পুড়ত
২
সে আসত, অভিসারিকা। ঘাসে ওর পায়ের আগুন
মৃদু চন্দ্রশিখা ওর আঙুল, ভাঙাচোরা
সেগুন
কাঠের রাঙা দরজায় টোকা মারত ঝুন
ঠুন, ঝুন
চাঁদের পেখম-পারা ওর দেবী
ব্র্যান্ডের গাউন
কনকচাঁপার সুগন্ধ মেখে বাতাসে
উড়ত ঝলমল
ঠোঁট থেকে খসে পড়ত গোলাপের
ফিসফিস পাপড়ি
স্থির গাছ জানালায়; স্নায়ুর
শাখাগুলো চঞ্চল
স্পন্দিত পুষ্প আমার আকাঙ্ক্ষা পেন্ডুলামের
ন্যায়
দুলত ওর কানের ফর্সা ঝুমকোলতায়,
জোছনায়
বিপন্ন মরালী যথা ডাকত
চাপাস্বরে : রাজপুত্তুর,
বাড়ি আছো? রা-জ-পু-ত্তুর? এসেছি
আমি। সাড়া দাও, শূর
সাড়া দিতাম না আমি। কাচের কুসুম
ভাঙত প্রাণ;
পঞ্চপ্রদীপে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম
ওর পাঁচটি বাণ
যেমন বইয়ের ভাঁজে গুছিয়ে রেখেছি
বন্ধুর
দেওয়া ময়ূরপালক। সেই পালকস্মৃতিময়ূর
নিঝুম কোনও বর্ষায় তুমুল নাচবে
চৌরাস্তায়
বিকচ কবরী খুলে , মেহগনির
জানালায় ।
হঠাৎ পাওয়া ফাঁকা ঘরে তার
চিবুকের নীলা
সপ্তরতি ঘাম দিয়ে গেঁথে রেখেছি জপের
মালা
কোনোদিন অনির্বাণ দীপ ফুঁ দিয়ে
নিভিয়ে ফেলে
চোখে রাখবো মুগ্ধ চোখ, ক্ষুধাতৃষ্ণাদি
সমস্ত ভুলে
তাকে ডাকব: বিভাবরী, এসেছ? টকটকে
ছোঁয়া দাও
ভিতর থেকে দরজা খোলা। এসো, রাধাচূড়া ফোটাও,
কিন্তু সেদিন লন্ঠন নেভাতে
পারিনি। চন্দ্রমৌলী
বিভাবরী অজন্তার উর্বশীর মতো
এসেছে কাছে
কবরী থেকে খসাতে পারিনি আফিমের
ফুলগুলি
নির্বাসিত সব্যসাচী দণ্ড অরণ্যে
অজ্ঞাতবাস
তিরের ফলায় লেগে আছে ঘুরন্ত
মাছের বাস
সে ছিল যত সুন্দরী তত ইস্পাতের
তরবারি
কীভাবে সাড়া দিতাম: অন্নপাত্রে মীন শিকারী?
তখনও রাজা অশোক দয়ানদীর রক্তিম
জলে
আবক্ষ স্নানের পর, শিরস্ত্রাণ, অসি
ছুঁড়ে ফেলে
নৈশ আহারে বসেননি। ছ’টি যবের
রুটি পদ্মের
পাতায়। মৃৎপাত্রে সুরা। উষ্ণ
মাংস বন ময়ুরের
কোনও এক বসন্তের তিমিরে চাঁদের ধুধু
রোদে
লিখে ফেলেননি চোদ্দটি কাব্য। লিপি পুড়ে যাচ্ছে রোদে
কলিঙ্গের জলপথ জিতে নিলে আড়াই
লক্ষ
সাধের বদলে অন্নবস্ত্র তাৎপর্য
আমার লক্ষ্য
কেরোসিনের আলোয় খুঁজছি শার্দূল,
অশোকস্তম্ভ
গড়বার জন্যে। বাঘের পিঠে সওয়ার
সেই সংকল্প
তখনও আনারকলি জ্যান্ত কবরে
খুঁড়ছে সুড়ঙ্গ
শ্বাস ও স্বস্তির জন্যে, নীলিমা
খোঁজে খাঁচা-বিহঙ্গ
তখনও নাদীর শাহ্ লণ্ডভণ্ড করছে
রাজধানী
চোখ থেকে কাঁটাচামচে তুলে
নিচ্ছে কোহিনূর মণি
সীতার এক—আমাদের শত পরীক্ষা
রাতজাগানি
সে এসেছে, কড়া নাড়ে পর্ণকুটিরের
দ্বারে দ্বারে;
উপোসী ঠোঁট কীভাবে ওর ঠোঁট
রাঙাতে পারে?
তখন আমি রূপনাশা চাষি। আলুর জমিতে একা
প্রখর রোদে তাড়াচ্ছি, ঝেড়ে
ফেলছি ফাইটফথোরা পোকা
তোমার সুগন্ধি শ্বাস নয়—ঝঞ্ঝার
নিয়তবায়ু,
বাসি, বা না বাসি ভালো তবু বালিঝড়
শ্বাসবায়ু
বাকলে লুকিয়ে রাখছি গ্লুকোজ ও
রাতের নীহার
বিরামে মেপো, সজনি, আমার তুমুল
বিএমআর
তুমি ঠোঁট দিতে পারো। দিতে পারো উষ্ণ আলিঙ্গন;
হে সাংখ্যমনীষা, দিতে পারোবনের বিয়ের পণ ?
কাবলি ছোলার পাশে তৃপ্তি আর
টাটকা ফুলকো লুচি ?
বিনা ভোজনে জন্মায় কৃষ্ণগহ্বরের
অরুচি?
তখনও সুশ্রুতের মতো বেনারসের
ঘাটে শরীর
খুঁটে দেখছি কোনখানে নিহিত এই
মহাজীবন;
কী চাই প্রাণ—বৈভব না
ভিক্ষাপাত্র শাক্যমুনির
জানুয়ারির আদিম রাতে
বল্লরিচঞ্চুকপোত-
ওড়া গ্রিটিংস কার্ডও ভেঙে দেয়
তাসের জগত
স্থিতি আর গতি জাড্যে মধ্যবর্তী
চ্যাপ্টা স্যান্ডুইচ
রোমকূপে ভেসে যায় জুঁইকুড়ি আর
মনসিজ
পায়ের তলায় তপ্ত বালি হাতে
নিঝুম লণ্ঠন।
ময়ূর খুঁজি। খেজুর ছায়ায় পূর্ণ প্রতিফলন
ব্যাকুল চপ্পলের ধ্বনি তবুও অপর
রিসিভারে
দূর থেকে ভেসে আসত বিরহোৎকণ্ঠিত
কর্ণকুহরে
ঠেলে ফেলে এসেছে মধ্যাহ্নের
অসমাপ্ত গ্রাস
টেলিফোন বুথের ভিতর গলে যাচ্ছেন
পিথাগোরাস
বরফের বহু নীচে আমাকেও দিয়েছি
কবর
বার বার টেলিফোন ঘুরে গেছে, সে পায়নি
খবর
৩
সেদিন দরজার বাইরে ঘুরছিল
উৎকণ্ঠিত নিক্কণ
সেদিন কনকচাঁপার যজ্ঞোত্থিত
নম্র হুতাশন
সেদিন বোকাচিত্ত’র স্বর্ণচাঁপা
ছিল আবরিত
নক্ষত্র-ফোটা কলাপে। খুঁটছিল ঘাস ইতস্তত
যেন তূণের ভিতর উপচে পড়া চিকন
ব্রহ্মাস্ত্র
যার সামনে নতজানু হওয়া ছাড়া পাল্টা
মার নেই
হে পূর্ণ বিকচ অতসী, আজ যাও। হে নারায়ণী অস্ত্র,
আজ সাড়ে তিন হাত মাটির ’পর
দাঁড়িয়ে থাকা
এসো যেদিন পায়ের তলায় থাকবে
আস্ত বসুধা
৪
নিক্কণ থেমে গেছে। শেষরাত্রি কেতকী ঝরায়
প্লুতস্বর স্বপ্নভাঙা ভোরের
রাজহংসীর গলায়
একটি গুমোট মেঘ, বুক কুচিকুচি
করা স্তব্ধতা
উঠোনে কাচের চাঁদ-প্লেট ঝন ঝন করে ভাঙে
সে চলে গেছে
তরঙ্গ ঝরে কুয়াশা মাখা সায়রে
আমার মৌন মুখর কথারা দিগন্তে
সারে সারে
ওড়ে। ডুমুর গাছের মাথা থেকে ঝরে
গেছে চাঁদ
ঝরা পাতায় ছড়িয়ে শিশিরের চাপা
আর্তনাদ
ক্লান্ত ভোর, ক্লান্ত চোখ। চোখের
মতো লাল ঊষাকাল
তোমার ফেলে যাওয়া ঘাসে
শুরু হয় সোনালি সকাল
৫
এ-জীবন হেসে ওঠে বনটিয়ার রঙিন
ঠোঁটে
চন্দন কাঠের বাংলো। সুখের
ডালিয়াক্ষেত ফোটে
মেহগিনির টেবিল। চা’য়ে ডোবাই সোনার বিস্কুট
ওয়ার্ডরোব ভরে গেছে। আরামে আছে শাড়ি ও স্যুট
রুপোয় মাজা দেওয়াল ঘাসে আবৃত লন,
সুইমিং
পুল। পর্টিকোয় ঠেকা চেরি-লাল
ক্ষিপ্র মার্সিডিজ
শার্সিতে শার্সিতে আঁকা
খাজুরাহর গ্লাস পেন্টিং
দুপুরে সর্ষে ইলিশ, রাতে গলদা
চিংড়ির কারি
শপিং মল, রেস্তোরাঁ, পাইন
অরণ্যের পানশালা
কব্জিতে জড়িয়ে রাখি চুনিপান্নার
স্লিম মালা
রুদ্ধশ্বাস সুখ। পণ্যতরীতে তারার ফুলঝুরি
ভিআইপি বক্সে নাচি, মহাশূন্যে
ছায়াপুঞ্জ জ্বলে,
তবুও কই মাছের ফুলকা আটকে আছে
ঘুনজালে
৬
সুখ ডালিয়ার মতো ঝরে। ঝাঁক টিয়া উড়ে যায়
সন্ধ্যে হওয়ার আগে। নীল নদীর খাঁখাঁ কিনারায়
শস্যমুখর পড়ে থাকে বটের একলাটিয়া
বন
তোমার জন্যে স্বপ্নপরি হঠাৎ ডুকরে ওঠে মন
তুমি শুধু ঘুম নও আত্মমন্থনোত্থিতা
কবিতা
বস্তুপুঞ্জের নিচোল নিবৃত
পদ্মনাভি, অমৃতা
তোমার স্বপ্নগুলো রোজ রাতে আমায়
খুঁজতে আসে
আমি শুধু সরে গেছি নির্বাণী ঘাসের থেকে ঘাসে
৭
কত দিন ঘুমোওনি ঘুম, জেগেছ
ঝুলন্ত বারান্দায়!
মাড়িয়ে চলি সন্মার্গ, ছেয়ে আছে
উল্কার কাঁটায়
তোমার কাছেই ফিরে এলাম, হে
আজন্ম বঞ্চিতা
অন্ধকার পায়ে পায়ে আজ তোমাকে
খুঁজছি, কবিতা
কোথা ছিল যেন ওর বাড়ি ? ছিল শ্যামল
উপত্যকা
বন ছিল সূর্যমুখীর। মেহগনির কুটির ছিল
ছিল চন্দ্রমল্লিকার খেত। কুয়ো
ছিল চাঁদ–ছাঁকা
মাছরাঙার পালকনিভ দু’বাহু
ঝরোকায় ছিল রাখা
মাড়িয়ে চলেছি পথ শরবিদ্ধ
চক্রবাক পাখি
আবছা মেহগিনির কুঠি বহুদূরে
অনির্বাণ বাতি
তুমি কি আজও দাঁড়িয়ে আছো,
শ্রেয়সী, উজ্জ্বল জ্যোতি?
কালঘাম ঝরে। গলা শুকায়। হাপায় লক্ষ্মী পেঁচা
বহু খনি খুঁড়ে এসেছি স্বর্ণশ্রমিক।
হয়নি বাঁচা
বুক ধক ধক করে—এক হাত দূরে বন্ধ দুয়ার
কক্ষ কক্ষান্তরে স্বর্ণ চাঁপার
আভা, কোমল গান্ধার
ময়ূরীর পালক ঝরে আছে ঘাসে–বিষাদ
যথা
দেখা দাও, পদ্মপাণি, সমস্ত
দুঃখের উপকথা
জলের সমান বলি। খোলো দ্বার। সখি, খোলো দ্বার
হাতে দাও শূন্য হাত, সরাও শরের
অন্ধকার
৮
রাজকুমারী, বাড়ি আছ? কড়া নাড়ি
বন্ধ দরজায়
আমার সকল বিত্ত নিয়ে ফকির করো
আমায়
সাড়া নেই
স্তব্ধ কুঠি
পাখি ডাকে আমার আর্তনাদ
বাঁশের চাঁই-এ বসি। ঝরাপাতা পোড়ে মায়াজলে
মেহগনির মাথা থেকে পাতকুয়োর নিথর
ঝিলে
ঝাঁপ দিয়ে ভাসতে থাকে,
মুছে যায় একলাটিয়া চাঁদ
[কবিতা আশ্রম (মুদ্রিত)-এর আগস্ট ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment