সময়ের স্রোতেই ভেসে যায় ‘মুয়ূরপঙখী নাও’
রুমা তপাদার
শূন্য দশকের কবি জয়দেব বাউরীর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ময়ূরপঙ্খি নাও’। প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০১৪। সমগ্র কাব্যগ্রন্থটি দুটি পর্যায়ে
বিভক্ত। প্রথম
পর্যায়ে ৪১টি কবিতা রয়েছে, দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ১২টি। এমন কাব্যগ্রন্থের কাছে নতজানু হয়ে
বসে থাকি সময়ের মতো। সময়ের
কথা দিয়ে শুরু হয়ে সেই সময়ের স্রোতেই ভেসে চলেছে তার নাও। প্রথম পর্যায়ের প্রবেশক----“যে দিন হয়েছে গত চোখে মুখে তীক্ষ্ণ
ক্ষত রেখে মননের গায়ে জাগে তার শোক”...এমনই বিদ্যুৎঝলক পঙ্ক্তি দিয়েই বইটির শুরু হয়। এরপর ‘হলুদ কুয়াশা’র হাতছানি পাঠককে ক্রমশ ভাসিয়ে নিয়ে
যায় ‘ঘুমন্তের জেগে থাকা চোখে’ র মতোই। তৃতীয় কবিতায় ‘আকাশ ভরসা জমি দিনে দিনে হয়ে পড়ছে
অনুর্বর’...এর পরেই আবার নিজস্ব ‘জমিন’ গন্ধ অনুভব করেছেন কবি। এই কবিতার সঙ্গে কবির একাত্মতা অনুভব
করার মতোই, “কত ঘামে তৈরি হয় সুগভীর কূপ?”----এ তো কবি ঘরের কথা-ই বলতে চেয়েছেন। “পূর্ণিমার পরে পরে বিমূঢ় চাঁদের মতো
দেখি/ ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের ঘর-বার সব।” কবি জয়দেব বাউরীর কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য
তাঁর কাব্যভাষা, রাঢ়ি উপভাষার সঠিক স্থানে
প্রয়োগ। একবারের জন্যেও মনে হয় না শব্দগুলি আরোপিত বলে। আমাদের বাংলা কবিতায় বিশেষ কিছু শব্দসমষ্টিরই
ঘোরাঘুরি লক্ষ করি। কবি এখানেই সতন্ত্র। এই কাব্যগ্রন্থে কবি নিজের ভাষা, নিজস্ব
জীবন নিয়েই লিখেছেন কবিতাগুলি। তাঁর ভাষা ধার নিয়ে বলা যেতে পারে, “বহুদূর গ্রহ থেকে ভেসে আসছে ছমছম ধ্বনি
/ ব্রজের না নূপুরের? পার্থক্য বোঝার বোধ শেষ!”
‘দূরত্ব’ কবিতায় তাঁকে আরও কাছের করে চিনতে
পারে পাঠক---‘উপত্যকা
লাজুক’---এমন
শব্দের প্রতি ঘোর-লাগা
জন্মায়। এরপর
সোজাসুজি! ‘একুশ
শতক’-এ
প্রবেশ ঘটে পাঠকের। “পরম কুলীন আমি, ....আলোকবর্তিনী তুমি...আমার যন্ত্রণা
বাড়ে রোজ...” সময়
আঁকড়ে কবি কঁকিয়ে উঠেছেন। ‘ভাসান’-এ এসে নতজানু কবির স্বীকারোক্তি “অনিশ্চিত ভেসে যাই বাংলাভাষা নিয়ে।” কবিতার শেষে এসে দীপ্তকণ্ঠে কবির উচ্চারণ, “অত্যাধুনিক বাঙালির মনে গড়ে দেবে মাতৃভাষা
বোধ।”
তারপরেই আসে “বিলাসী বাতাস এসে ঘুরিয়ে নেয় নৌকার
যাত্রা--/ অভিমুখ, অনুকূলে ভেসে যায় জীর্ণতরী প্রতিরোধহীন।” শূন্যদশকের ক্লান্তি, রোজকার জীবনের তৃষ্ণা থেকেই কবি “আঁজলা আঁজলা জল” ফেলে ফেলে কবিতার ‘প্রতিরোধহীন’ নাও ভাসিয়ে চলেছেন তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ
‘ময়ূরপঙ্খি নাও’-এ। ‘ফিরেদেখা ১৯৯২’-এ “বিপন্ন পাখিরা সব ঝলসানো ডানা নিয়ে”, চিত্ত আকুলতার চিত্র ভেসে ওঠে পাঠকের
কাছে। আমরা
যে সময়ের উপর বেঁচে রয়েছি, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ফেলে আসা সময়ের ‘বিউটি স্পট’-কে কবি তাঁর কবিতায় কলমকনসিলার দিয়ে
পাঠক-চোখে সুদৃশ্যমান করে তুলেছেন।“চাপ চাপ অন্ধকার তুলে আনি উঠোনে তোমার/ তুলে আনি প্রতিদিন মূল্যহীন খনিজ সম্ভার।” অথবা“স্বপ্নের রঙিন ভূম বেদখল হতে হতে দেখি/ কিছুমাত্র অবশিষ্ট পড়ে নেই আর।” -----বাকরুদ্ধ করা এইসব পঙ্ক্তির ব্যবহার তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। আবার তাঁর কবিতা আমাদের“ঘুমপাড়ানি আলো দিয়ে
নিয়ে যায় অন্য এক দেশে” কারণ তিনি জানেন “পৃথিবীতে রাত্রি ভোর হয়।” এরপর ‘বদল’ আসে, ‘উপেক্ষিত ঘাসগুল্ম’ দিয়ে ‘কবিজন্ম হায়’ বলে “পৃথিবীর চওড়াতম নদী”-র উপর দিয়ে তাঁর নাও বয়ে নিয়ে চলেন “ভাঙা ব্রিজে হেঁটে চলা সাবধানী মানুষ”- এর মতো। ‘দিনকাল’-এর ‘দাহ’ পেরিয়ে কবি বলেন, “ফিরে আসি জন্মালোকে”। কবিহৃদয়ে ক্ষীণ আশা “টুসু জাগে পুরুলিয়া বাঁকুড়ার হাতে
গোনা গ্রামে।”
‘ফেরিওয়ালা’ কবি ‘পথ-ঘাট’-এর ‘ডুবন্ত শস্য’ অতিক্রম করে বলে ওঠেন-----“এবার ছুঁড়বো মাছের চোখে তির/ ঘুরিয়ে নেবো মুখ ফেরানো আলো/ অনুন্নত, উঁচুতে তোলো শির/ বিতর্কিত ভীমরুল চমকালো।”
এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে পাঠকের প্রবেশ
ঘটে, “পাতা ঋগ্ধ গাছে গাছে উলুধ্বনি বাজে সমারোহে”। এই ‘সিস্টেম’-এর উপর দিয়ে ‘মনোরম অন্ধকার’ কবির ‘ময়ূরপঙ্খিনাও-২’ কবিতায় এসে পাঠক হৃদয় আরও বেশি সজাগ হয়---“মৃদুমন্দ ঢেউ ভাঙে অবিরাম”।
. শিল্পী চন্দন মিশ্রের কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে যথাযথ প্রচ্ছদ
বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। একজন তরুণ পাঠক হিসাবে এই কাব্যগ্রন্থটির সঙ্গে
একাত্ম হতে পারি।
[এটি নতুন লেখা]
[এটি নতুন লেখা]
No comments:
Post a Comment